ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন

দায়সারা নির্দেশনা ইসির, অস্ত্র উদ্ধারে মনিটরিং নেই

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩৫ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৬
দায়সারা নির্দেশনা ইসির, অস্ত্র উদ্ধারে মনিটরিং নেই

ঢাকা: চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের সহিংসতা রোধে কেবল নির্দেশনা দিয়েই দায় সারছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংহিসতা বা অনিয়ম হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতার কোনো উদ্যোগ নেই।

নেই অস্ত্র উদ্ধারের ক্ষেত্রে কোনো মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও।

বড় অনিয়মে ভোটগ্রহণ স্থগিত বা জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব সম্পন্ন করছে সংস্থাটি। আর ইসির এই দায়সারা মনোভাব এবং মনিটরিং না থাকার কারণেই নির্বাচনে সহিংসতা রোধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকেই কেবল বড় দায়িত্ব বলে ভাবছে নির্বাচন কমিশন। কেননা, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে শক্ত হাতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার নজির সৃষ্টি করতে পারেনি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের বর্তমান কমিশন।

পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে প্রায় ৩০ জনের মতো নিহতের খবর গণমাধ্যমে এলেও নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে চার ধাপের নির্বাচন শেষে এ সংখ্যা ৮০-তে পৌঁছেছে। যা আরও বাড়তে পারে বলেও শঙ্কা তাদের। অথচ দশম সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কোনো নির্বাচনেই এতো মানুষ মারা যায়নি।

এদিকে নির্বাচন কমিশন প্রতি নির্বাচনের মতো ইউপি নির্বাচনেও বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য নির্দেশনা দিয়েই কেবল দায় সেরেছে। এরপর আর কোনো মনিটরিং করেনি। ফলে ইউপি নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার অব্যাহত রাখার খবরও গণমাধ্যমে আসছে।

ইসির উপ-সচিব পর্যায়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বাংলানিউজকে জানান, ইউপি নির্বাচনে কী পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই। কেননা, অস্ত্র উদ্ধারে সাঁড়াশি অভিযানের জন্য পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হলেও সে কাজের কোনো অগ্রগতি আর জানতে চাওয়া হয়নি।

তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন এ বিষয়ে উদাসীনতার কোনো সুযোগ নেই ইসির। তাদের অবশ্যই অস্ত্র উদ্ধারে বিষয়ে শক্ত হওয়া উচিত ছিল।

এদিকে ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন বিগত নির্বাচন কমিশনের সময় অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি খুব কঠোরভাবে দেখা হতো। তখন কোন থানায় কত অস্ত্র জমা পড়েছে, কত অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে তার হিসাব সময়ে সময়ে নেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমান কমিশন এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন চায় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির দায়িত্বশীল যুগ্ম সচিব জেসমিন টুলী বাংলানিউজকে বলেন, অস্ত্র জমা নেওয়া বা উদ্ধারের বিষয়ে কিছু জানি না। সচিবকে জিজ্ঞেস করুন। তিনিই প্রকৃত স্পোকসম্যান। আমি না।

এ ব্যাপারে জানতে সচিব সিরাজুল ইসলামকে ফোন দিলে তিনি ফোন ধরেননি।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সহিংসতার জন্য সিংহভাগ দায় নির্বাচন কমিশনের। ৮০ জন মানুষ মারা গেল। অথচ তাদের কোনো দায় নেই। নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের অবশ্যই উচিত ছিল অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়ার। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের কোনো পদক্ষেপ নেই। পরিস্থিতি এমন পর‌্যায়ে চলে গেছে যে, নির্বাচন কমিশন আর নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে আমার আর কিছু বলতে ভাল লাগে না।

পর্যবেক্ষকরা আরও বলছেন, নির্বাচনে অনেক গৃহস্থালী অস্ত্রেরও ব্যবহার হয়েছে। শুধু সন্ত্রাসীরা গুলিই করেনি, গ্রামের শান্তিপ্রিয় মানুষেরাও দেশীয় গৃহস্থালী অস্ত্র নিয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে নির্বাচনে আর উৎসব নেই।

এক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশনের কোনো মনিটরিং নেই বলে ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ইউপি নির্বাচনে পুলিশ, আনসার, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রায় দুই লাখ ফোর্স মাঠে রয়েছে। কিন্তু সহিংসতার কোনো প্রতিবেদনও তাদের কাছ থেকে নেয়নি ইসি।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, নির্বাচন কমিশন দায়সারা আচরণ করছে। তারা আদেশ-নির্দেশ দিয়েই কেবল দায়িত্ব শেষ করছে। আদেশ-নির্দেশের কতটুকু পালন হলো তা মনিটরিং করছে না। অস্ত্র উদ্ধারও যে কারণে হয়নি। আবার একই কারণে সহিংসতা নিয়েও তাদের কোনো স্টাডি নেই।

নির্বাচনে অনিয়ম বা সহিংসতার জন্য তিনি সরকারেরও দায় এড়ানো সুযোগ নেই বলে মনে করেন। কলিমউল্লাহ জানান, যেভাবে গ্রামের মানুষ মাছ ধরার ট্যাডা, দা, কুড়াল নিয়ে হতাহতের কাণ্ড ঘটাতে লিপ্ত হলো, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে একা দুষলে ঠিক হবে না। কেননা, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্য বিভাগের সহায়তা দরকার হয় ইসির। আর ইউপি নির্বাচনে সহায়তাকারীরা সঠিকভাবে সহায়তা করেনি। তাই সরকারও ইউপি নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান রোববার (৮ মে) রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ইউপি নির্বাচনে সংঘাত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নয়, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে ঘটছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঠিকভাবে কাজ করছে।

অন্যদিকে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ইতিমধ্যে বলেছেন, ইউপি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধই নয়, গুলিবিদ্ধও।

তোফায়েল আহমেদের মতোই সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সহিংসতা ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা আর নেই। দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়ার কারণেই এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারাও সিলমারাসহ নির্বাচনী কারচুপিতে জড়াচ্ছেন।

ইউপি নির্বাচন এমনিতেই নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। তারওপর এবার দলীয়ভাবে নির্বাচন হচ্ছে। আর এ কারণেই ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারাও অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে এ থেকে উত্তরণের পথ সহসা মিলবে না বলেও মনে করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার।

দেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউপিতে এবার ছয় ধাপে ভোটগ্রহণ করছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ২৮ মে পঞ্চম ধাপে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। আর ৪ জুন ষষ্ঠ ধাপের ভোটগ্রহণের মধ্য দিয়ে নবম ইউপি নির্বাচন সমাপ্ত হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৯ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৬
ইইউডি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।