ঘুমন্ত শহরে ফেরারি মন নিয়ে রূপালি গিটার হাতে কষ্ট পেতে ভালোবাসি! আইয়ুব বাচ্চু জীবনের গল্প যেন এমনই। এ জীবনের ২৫টি বছরই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন এলআরবি ব্যান্ড নিয়ে।
২৫ বছর পূর্তির মাইলফলক স্পর্শ করাটাকে উদযাপনের জন্য মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) হয়ে গেলো রজতজয়ন্তী কনসার্ট। ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার বসুন্ধরার নবরাত্রি মিলনায়তনে সন্ধ্যা গড়ানোর পরপরই শুরু হয় আইয়ুব বাচ্চু ও এলআরবির পরিবেশনা। তাদের সুরে গলা মিলিয়েছে হাজার হাজার তরুণ। সবাই মেতেছিলো উল্লাসে, আনন্দে।
কনসার্টটি আয়োজন করে উইজার্ড শোবিজ। অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গানের লাইব্রেরি রবি ইয়ন্ডার মিউজিক। যারা কনসার্টে যেতে পারেননি তাদের জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু মুহূর্তের বর্ণনা।
গিটার কথা বলে...
প্রয়াত বিখ্যাত গিটারশিল্পী জিমি হেন্ড্রিক্সের মুখাবয়বের ছাপ দিয়ে নকশা করা টি-শার্ট পরে মঞ্চে আসেন আইয়ুব বাচ্চু। মাথায় রাখা টুপিতে লেখা ‘এলআরবি’। ২৫ বছর ধরে এই ব্যান্ডকে এভাবেই মাথায় করে রেখেছেন আইয়ুব বাচ্চু। আর দুই হাতে গিটার। তার হাতের আঙুলগুলোর ছোঁয়া পেলেই যন্ত্রটা যেন ভাষা খুঁজে পায়।
চার ঘণ্টা ধরে গিটারে ঝড় তুলে শ্রোতাদের সুরের সাগরে ভাসালেন আইয়ুব বাচ্চু। ২৫ বছর পেরিয়েও এলআরবি ব্যান্ডের এই কান্ডারির মনেপ্রাণে, চোখে-মুখে তারুণ্যের স্ফুলিঙ্গ। এ দেশের রকসংগীতে তাকে কেনো জাদুকর গিটারশিল্পী বলা হয় তা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এদিন বুঝেছে দর্শক-শ্রোতা। তিনি আর গিটার যেন দুইয়ে মিলে একাকার!
শ্রোতারাই গায়ক!
‘চলো বদলে যাই’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘মন চাইলে মন’ ‘সুখী ছেলে’, ‘পাল তোলা নায়’, ‘হাসতে দেখো’- এমন অনেক জনপ্রিয় গান এদিন পরিবেশন করেছে এলআরবি। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, সবই শ্রোতাদের মুখস্ত। এটা দেখে অবাক আইয়ুব বাচ্চু নিজেও। এজন্য মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করলেন। স্বপন (বেজ), মাসুদ (লিড গিটার) আর রোমেলও (ড্রামস) শ্রোতাদের এই ভালোবাসা দেখে অনুপ্রাণিত হলেন।
আইয়ুব বাচ্চু দুই-তিনটি গান পরিবেশনের পরপরই তাই শ্রোতাদের উদ্দেশে বলছিলেন, ‘আপনারাই আমাদের শক্তি। পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশি দর্শক-শ্রোতা সেরা। এখানে বিদেশের সব শিল্পীই এলে নিজের দেশ মনে করেন, এর মূল কৃতিত্ব আপনাদের। আপনারা এতো ভালো বলেই এটা সম্ভব হয়। আপনাদেরকে সালাম জানাই। ’
আফজালের দেখা অখ্যাত আইয়ুব বাচ্চু
কনসার্টে এসে ‘সেই তুমি কেনো অচেনা হলে’ গানটি গেয়ে সবার চিরচেনা হয়ে যাওয়া আইয়ুব বাচ্চুকে অখ্যাত দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন অভিনেতা-নির্মাতা আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘ভালো লাগছে কারণ আজকের খ্যাতিমান আইয়ুব বাচ্চুকে অখ্যাত থাকার সময় থেকে দেখেছি। তিনি যখন গান শুরু করেছিলেন তখন রেডিও ছিলো একটা, টিভি চ্যানেলও ছিলো একটা। ক্যাসেট প্রকাশিত হলেও সব জায়গায় পৌঁছাতো না। এমন একটা পরিস্থিতি থেকে বাচ্চু ঠিকই শ্রোতাদের কাছে পৌঁছেছে। এখানেই তার সার্থকতা। ’
যোগ করে আফজাল আরও বলেন, ‘দেশের বিজ্ঞাপনচিত্র ভুবনকে জনপ্রিয় করার পেছনে আইয়ুব বাচ্চুর বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তিনি অসংখ্য বিজ্ঞাপনের জন্য সংগীত রচনা করেছেন। ’
আফজাল হোসেনের পাশাপাশি আইয়ুব বাচ্চু ও এলআরবিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান অভিনেতা-নির্মাতা শিশু সাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগর ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। তারা চকোলেটও বিতরণ করেন শ্রোতাদের দিকে। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, ‘আমার ১১ বছরের ছেলে বাচ্চু ভাইয়ের গানের ভক্ত, আমিও তার ভক্ত, আমার ৭২ বছরের মা-ও তার ভক্ত। তিনি আমাদের তিন প্রজন্মকে উদ্দীপনা দিয়ে যাচ্ছেন। ’
জঙ্গীর স্মৃতিচারণ
‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে, মায়াবী সন্ধ্যা, চাঁদ জাগা এক রাতে, একটি কিশোর ছেলে, একাকী স্বপ্ন দেখে, হাসি আর গানে, সুখের ছবি আঁকে’- এলআরবির জনপ্রিয় এই গানটি লিখেছিলেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। ক’দিন আগে তিনি আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। গানটি পরিবেশনের পর তাকে মঞ্চে ডাকেন আইয়ুব বাচ্চু।
এলআরবির আগে আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন সোলসের অন্যতম সদস্য। সেই স্মৃতিচারণ করে শহীদ মাহমুদ জঙ্গী বলেন, ‘ও আমার ছোট ভাই। আমাদের ৪০ বছর ধরে জানাশোনা। সোলস ছেড়ে দেওয়ার পর কঠিন সময় গিয়েছিলো ওর। সে বাসা থেকে টাকা-পয়সা নিতো না। তার ওপর তখন সদ্য বিয়ে করেছে। একদিন ওকে বললাম তুমি ব্যান্ড করো। ব্যান্ড করলে তুমি অনেক ভালো করবে দেখো। ’
আজম খানের ‘বাংলাদেশ’
প্রয়াত পপসম্রাট আজম খানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার ‘হায়রে হায় বাংলাদেশ’ গানটি গেয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। তার আগে তিনি বলেন, ‘তিনি আমাদের পথপ্রদর্শক। তার দেখানো পথে আমরা বাংলা রকের চর্চা করেছি। এ প্রজন্মের তরুণরা ব্যান্ডসংগীতে এসেছে সেই পথ ধরেই। তিনি সেই সময় সংগ্রামটা না করলে আমরা এতোটা পথ পাড়ি দিতে পারতাম না। সেজন্য তাকে জানাই হাজার সালাম। ’
তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের তীরন্দাজ ও সিলেটের কলরব ব্যান্ডের দুই গায়ককে মঞ্চে ডেকে এনে ‘ঘুমন্ত শহরে’ গাওয়ার সুযোগ দেন তিনি। আইয়ুব বাচ্চু গিটারের সঙ্গে গান পরিবেশনের এমন সুযোগ নিশ্চয়ই এ দুই তরুণকে চলার পথে প্রেরণা জোগাবে।
‘নিরবে’র মিউজিক ভিডিও
কনসার্টে এলআরবির জনপ্রিয় গান ‘নিরবে’র মিউজিক ভিডিও প্রকাশিত হয়। এটি দেখানো হয়েছে মঞ্চের দু’পাশের পর্দায়। এ নিয়ে পাঁচ বছর পর এলো তাদের নতুন কোনো মিউজিক ভিডিও। এটি নির্মাণ করেছেন মনজু আহমেদ| অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন আলিফ চৌধুরী।
জুনিয়র আইয়ুব বাচ্চু
কনসার্টের শেষ প্রান্তে দর্শক-শ্রোতাদের চমকে দিয়ে মঞ্চে আসেন আইয়ুব বাচ্চুর উত্তরসূরী কিশোর আহনাফ তাজোয়ার আইয়ুব। বাপ-বেটার দ্বৈত পরিবেশনায় শ্রোতারা বিমোহিত হয়ে থাকে। বলা যায় বাবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গিটার বাজিয়েছেন আহনাফ। গিটারিস্ট হিসেবে যে এই তরুণ অনেকদূর যাবে তার একটা মহড়া হয়ে গেলো এলআরবির ২৫ বছর পূর্তির কনসার্টে।
এলআরবির একছত্র
১৯৯১ সালে রক ব্যান্ড এলআরবি প্রতিষ্ঠা করেন আইয়ুব বাচ্চু। পরের বছর প্রকাশিত হয় তাদের প্রথম যুগল অ্যালবাম (এলআরবি ওয়ান অ্যান্ড টু)। এরপর একে একে বাজারে এসেছে ‘সুখ’ (১৯৯৩), ‘তবুও’ (১৯৯৪), ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫), ‘স্বপ্ন’ (১৯৯৬), ‘আমাদের বিস্ময়! ১ এবং ২’ (১৯৯৮), ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০০), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নাই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৭) এবং ‘যুদ্ধ’ (২০১২)।
আরও পড়ুন>>>
* ২০ ডিসেম্বর এলআরবির রজতজয়ন্তী কনসার্ট
* আইয়ুব বাচ্চুর অনুরোধ
বাংলাদেশ সময়: ২০৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
জেএইচ