অভিষেকেই ব্যবসাসফল বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন এমন নাট্যনির্মাতা রয়েছেন আরও কয়েকজন। কিন্তু মুশকিল হলো, তারা একটি বা দুটি ছবি তৈরি করে ক্ষান্ত দিয়েছেন।
সালাউদ্দিন লাভলু (মোল্লাবাড়ির বউ), গিয়াসউদ্দিন সেলিম (মনপুরা), শিহাব শাহীন (ছুঁয়ে দিলে মন)— টেলিভিশন নাটকে সফল এই তিন নির্মাতা অভিষেক ছবিতেই বাজিমাত করেছেন। তাদের অবস্থা এলেন, দেখলেন, জয় করলেন এবং চলে গেলেন যেন! কারণ সফলতার পরও চলচ্চিত্রে বাড়েনি তাদের ব্যস্ততা। চাহিদা থাকার পরও দ্বিতীয় ছবি হাতে নেওয়ার বেলায় দীর্ঘসূত্রিতায় পড়েছেন। কেন এমনটি ঘটছে, সেটি এক রহস্য বটে। শুধু যে লগ্নিকারীর সংকটে এমনটি হচ্ছে, তা-ও নয় নিশ্চয়ই?
সালাউদ্দিন লাভলুর বানানো ‘মোল্লবাড়ীর বউ’ (রিয়াজ, মৌসুমী ও শাবনূর) ২০০৫ সালের ব্যবসাসফল ছবি। বিপুল জনপ্রিয়তার পর ‘ওয়ারিশ’ নামে ছবির ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই পর্যন্তই, আলোর মুখ দেখেনি সেটি। নাটকেই দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন এই নির্মাতা। অথচ তার কাছে গ্রামীণ পটভূমির দারুণ গল্পের আরও কিছু ছবি পেতে পারতেন দর্শক। এক যুগেও দ্বিতীয় ছবি উপহার দিতে পারেননি লাভলু। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে!
‘মনপুরা’র ইতিহাস সবার জানা। নাটকের সফল কারিগর গিয়াসউদ্দিন সেলিম সব শ্রেণির দর্শককে হলে নিয়ে গিয়েছিলেন। দারুণ ব্যবসাসফল ছবি নির্মাণের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেননি তিনিও। এরপর ‘কাজল রেখা’ নামে ছবির ঘোষণা দিয়েছিলেন, এগোয়নি। এ অবস্থায় চিত্রনায়িকা পরী মনিকে নিয়ে দৃশ্যত দ্বিতীয় ছবি ‘স্বপ্নজাল’-এর কাজ শেষ করেছেন। দ্বিতীয় ছবি উপহার দিতে আলোচিত এই নির্মাতার কতো বছর সময় লাগছে জানেন? আট বছর!
২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিলো নাট্যনির্মাতা শিহাব শাহীনের প্রথম ছবি ‘ছুঁয়ে দিলে মন’। আরিফিন শুভ আর মমকে নিয়ে সফলতার মুখ দেখেছিলেন এই কারিগর। দীর্ঘদিন পর একই চলচ্চিত্রের অধিকাংশ গান জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বাহবা পেয়েছিলেন শিহাব। কিন্তু তিনিও ধারাবাহিকতা রাখতে পারছেন না। নাটকেই যেন মন সঁপেছেন, নাটকের ব্যস্ততাকেই যেন মাথা পেতে মেনে নিয়েছেন তিনি। অনানুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় ছবির (আনারকলি) ঘোষণা দিলেও চলচ্চিত্রের ময়দানে শিহাব শাহীন নেই বললেই চলে।
নাটক-বিজ্ঞাপন থেকে এসে অভিষেক ছবিতে বাজিমাত করেছেন, এর সবশেষ সংযোজন অমিতাভ রেজা ও দীপংকর দীপনের কথা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। এবার দেখা যাক, তারা কী করেন।
২০১৬ সালে ‘আয়নাবাজি’ দিয়ে দেশ কাঁপিয়েছেন অমিতাভ। দেশীয় চলচ্চিত্রে ভিন্নামাত্রা যোগ করেছেন এই মানুষটি। ঠিক এক বছর পর চলতি মাসে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দিয়ে রমরমা বাণিজ্যের স্বাদ নিচ্ছেন নির্মাতা দীপংকর দীপন। এ দু’জন সঠিক সময়ে দ্বিতীয় ছবির উপহার দেবেন, তেমন ঈঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, এটি বেশ আশাব্যাঞ্জক। সবার প্রত্যাশা, পূর্বসূরীদের মতো তারা যেন ধারাবাহিকতা ব্যাহত না করেন।
ছোটপর্দা থেকে বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে এসে মোটামুটি ধারাবাহিকতা রেখেছেন এস এ হক অলিক। ‘হৃদয়ের কথা’, ‘আকাশছোঁয়া ভালোবাসা’, ‘আরো ভালোবাসবো তোমায়’ ছবিগুলো তার প্রমাণ। তিনি একইসঙ্গে নাটক নির্মাণও চালিয়ে যাচ্ছেন। এই তালিকায় আরও আছেন মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ। ‘প্রজাপতি’, ‘তারকাঁটা’, ‘সম্রাট’ বানিয়ে নজর কেড়েছেন তিনি। অনিমেষ আইচও (জিরো ডিগ্রি, ভয়ংকর সুন্দর) ছবির ধারাবাহিকতায় ফিরবেন এমনটিই মনে করছেন তার ভক্তরা।
ছোটপর্দার ব্যস্ততম জনপ্রিয় অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকীর আহমেদ নিজস্ব ঘরানার ছবি তৈরি করে যাচ্ছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণে মোটামুটি নিয়মিত তিনি। সবশেষ ‘অজ্ঞাতনামা’ দিয়ে আলোচিত হন তৌকীর। ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘রূপকথার গল্প’, ‘জয়যাত্রা’য় নিজের মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন জনপ্রিয় এই নির্মাতা। অচিরেই আসছে তার নতুন ছবি ‘হালদা’।
ছোটপর্দা থেকে বড়পর্দায় এসে নিজস্ব ধারা প্রতীষ্ঠা তথা জীবনঘনিষ্ট ও নন-ফ্যান্টাসি ছবি বানিয়ে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি নিয়মিতভাবেই ছবি তৈরি করে চলেছেন। ‘ব্যাচেলর’, ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’, ‘টেলিভিশন’, ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ তার উল্লেখযোগ্য নির্মাণ। ২৭ অক্টোবর মুক্তি প্রতীক্ষিত ‘ডুব’কে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন ফারুকী।
অভিনেতা ও নির্মাতা গাজী রাকায়েত ২০১৩ সালে ‘মৃত্তিকা মায়া’ তৈরি করে সর্বাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘরে তুলেছেন। একইভাবে নির্মাতা রিয়াজুল রিজুও (বাপজানের বায়স্কোপ) জাতীয় সেরার স্বীকৃতি পেয়েছেন সর্বাধিক শাখায়।
এবার দেখা যাক এক বা একাধিক চলচ্চিত্র বানিয়ে আরও যারা আলোচনা তৈরি করেছেন, সেই তালিকা।
নাটক থেকে আসা সেসব চলচ্চিত্র নির্মাতারা (মূলধারা ও বিকল্পধারা) হলেন— নূরুল আলম আতিক (ডুবসাঁতার), মেহের আফরোজ শাওন (কৃষ্ণপক্ষ), আবু শাহেদ ইমন (জালালের গল্প), রেদওয়ান রনি (চোরাবালি, আইসক্রিম), তানিয়া আহমেদ (ভালোবাসা এমনই তো হয়), নোমান রবিন (কমনজেন্ডার), প্রসূণ রহমান (সুতপার ঠিকানা), খিজির হায়াত খান (জাগো), সোহেল আরমান (এইতো প্রেম), সামিয়া জামান (আকাশ কতো দুরে), আকরাম খান (ঘাসফুল), তন্ময় তানসেন (রানআউট), শাহরিয়ার নাজিম জয় (প্রার্থণা), সাইফ চন্দন (ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল), রওশন আরা নীপা (মহুয়া সুন্দরী), সানিয়াত (অল্প অল্প প্রেমের গল্প), মুরাদ পারভেজ (চন্দ্রগ্রহণ, বৃহণ্নলা), আশিকুর রহমান (মুসাফির, গ্যাংস্টার রিটার্নস), নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল (এক কাপ চা), শাহীন কবির টুটুল (এইতো ভালোবাসা), শাহনেওয়াজ কাকলী (উত্তরের সুর), আলভী আহমেদ (ইউটার্ন), হিমেল আশরাফ (সুলতানা বিবিয়ানা), শফিকুল ইসলাম খান (অচেনা হৃদয়), হাসিবুর রেজা কল্লোল (সত্তা), মিজানুর রহমান লাবু (তুখোড়, নূরু মিয়া ও তার বিউটি ড্রাইভার), ইফতেখার আহমেদ ফাহমি (টু বি কন্টিনিউড) প্রমুখ।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায়, ‘মেন্টাল’, ‘ধ্যাততেরিকি’, ‘বসগিরি’ ছবিগুলোর নির্মাতা শামীম আহমেদ রনিও একসময় নাটক বানাতেন। বাণিজ্যিক ছবিতে নিজেকে দারুণভাবে প্রমাণ করেছেন এই তরুণ।
অন্যদিকে সরাসরি নাটক তৈরি না করলেও স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে হাত পাকিয়ে চলচ্চিত্রে সফল হয়েছেন এনামুল করিম নির্ঝর (আহা), সৈকত নাসির (দেশা-দ্য লিডার), জাহিদুর রহিম অঞ্জন (মেঘমল্লার), ফাখরুল আরেফিন খান (ভুবন মাঝি), বুলবুল বিশ্বাস (রাজনীতি) প্রমুখ। সঙ্গতকারণেই তাদের পরের ছবির জন্যও দর্শক অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু তারা কোথায়?
এর বাইরে হুমায়ুন আহমেদ, নারগিস আক্তারসহ আরও অনেক নাট্যনির্মাতাই চলচ্চিত্রে নিজেদের প্রমাণ করেছেন ব্যতিক্রমী গল্প আর উপস্থাপনার কারণে।
এদিকে চলচ্চিত্রে পূর্বসূরীদের সাফল্যে আশায় বুক বাঁধছেন নাটকের তরুণ ও জনপ্রিয় নির্মাতারা। এই তালিকাও কম বড় নয়। তাদের কেউ কেউ চলচ্চিত্র তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন, এগোচ্ছেন শুটিং, কেউ অচিরেই নামবেন মাঠে। এমন নির্মাতাদের মধ্যে আছেন তানিম রহমান অংশু (আদি, স্বপ্নবাড়ি), রায়হান রাফি (পোড়ামন টু), সাইফুল ইসলাম মান্নু (পুত্র), মাহমুদ দিদার (বিউটি সার্কাস), রাশেদ রাহা (নোলক), মিজানুর রহমান আরিয়ান, আশুতোষ সুজন, মাবরুর রশীদ বান্না প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৭
এসও