নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের সিনেমাহলে হিন্দি চলচ্চিত্র: আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?’ শিরোনামে ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এ ওয়েবিনারে অংশ নেন চিত্রনায়ক রিয়াজ, নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী, মুশফিকুর রহমান গুলজার, ড. গীতি আরা নাসরিন, ড. হারিছুর রহমান, ড. জাকির হোসেন রাজু, অধ্যাপক শেখ তৌফিক এম হক প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে রাস্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হারিছুর রহমানের গবেষণাধর্মী সদ্যপ্রকাশিত ‘কনজিউমিং কালচারাল হেজেমনি: বলিউড ইন বাংলাদেশ’ বইয়ের উপর আলোচনা এবং বইয়ের মোড়ক উম্মোচন করা হয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের উপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি চলচ্চিত্র একই সময়ে বাংলাদেশের সিনেমা হলে মুক্তি দেয়ার কথা ভাবছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পীদের কিছু অংশ বাদে প্রায় সকলেই সরকারের কাছে সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের সিনেমা হলে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ করেছেন। কারণ, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দর্শকদের সিনেমা হলে টানতে ব্যর্থ হয়েছে।
সকাল ১১টায় জুম-এ শুরু হওয়া ওয়েবিনারে বাংলাদেশের সিনেমা হলে ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনের কারণ ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়।
অধ্যাপক শেখ তৌফিক এম হক পরিচালক, এসআইপিজি, বিভাগীয় প্রধান, পিএসএস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় তার সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে ওয়েবিনারের অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং গার্মেন্টস শিল্প যদি প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে একটা ভালো অবস্থান তৈরী করতে পারে, তাহলে চলচ্চিত্র কেন পারবে না।
অনুষ্ঠানে ড. হারিছুর রহমান তার বইয়ের উপর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, এ বইয়ে বাংলাদেশে বলিউডের চলচ্চিত্রের পরিবেশন এবং প্রদর্শনকে অনুসন্ধান করা হয়েছে। বইটিতে ঢাকা শহরে পরিচালিত এথনোগ্রাফিক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে যেখানে চলচ্চিত্রের দর্শক, চলচ্চিত্র শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক, প্রদর্শক এবং সমালোচকের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে। বইটি কিছু মৌলিক জিজ্ঞাসাকে সামনে নিয়ে এসেছে — যেমন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশি বলতে আমরা কী বুঝি? হিন্দি সিনেমার বাংলাদেশি দর্শক/অনুরাগী বলতে কী বুঝায়? অথবা কিভাবে জনপ্রিয় সিনেমা দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার সম্পর্ককে প্রতিফলিত করে? ড. রহমান এখানে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, কীভাবে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জাতিরাষ্ট্রের উপর ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক স্তরে হেজেমনিক অবস্থা তৈরী হয়েছে যা একইসাথে ভারতের সাংস্কৃতিক হেজেমনিকে সম্ভব করে তুলেছে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সিনেমা হলে হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রদর্শন সম্পর্কে চিত্রনায়ক রিয়াজ বলেন, চলচ্চিত্র উন্নয়নের জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার। যোগ্য লোককে যোগ্য স্থানে বসাতে হবে। ভালো লেখকের দরকার এবং ভালো কন্টেন্ট দরকার। তিনি সরকারের কাছে অন্যান্য সেক্টরের মতো চলচ্চিত্রেও প্রণোদনার কথা বলেন। তিনি সিনেমা হল নির্মানের উপর জোর দেন।
বলিউডের চলচ্চিত্রের বিপরীতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কিভাবে টিকে থাকতে পারে, এমন প্রশ্নের উত্তরে চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী বলেন, বলেন আমাদের একটা ফিল্ম কমিশন দরকার যারা দুদক এবং নির্বাচন কমিশনের মত চলচ্চিত্রের সবকিছু দেখভাল করবে। তিনি বলেন, যে কোন প্রতিযোগিতার মেধা দিয়ে পরিচয় তৈরি করতে হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, তার আয়নাবাজি সিনেমা ভারতের তেলেগু ভাষায় নির্মিত হয়েছে। তিনি মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণের কথা বলেন এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনে অর্জিত আয় থেকে যে নির্মাতাদের বঞ্চিত করা হয় তার কথা উল্লেখ করেন।
২০১১ এবং ২০১৪ সালে হিন্দি সিনেমার বিরোধিতা করলেও এখন কেন সমর্থন করেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে সভাপতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, আপাতত যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উঠে না দাঁড়ায় ততদিন পর্যন্ত হিন্দি চলচ্চিত্র হলে দেখানোর সুযোগ দেয়া হোক।
বইয়ের আলোচক হিসেবে ড. গীতি আরা নাসরিন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, চলচ্চিত্রের লোকজনকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিল্পের বিভিন্ন দিককে যেমন উৎপাদন, বন্টন এবং তার শ্রমকে পদ্ধতিগতভাবে দেখা এবং দুর্বলতা কাটাতে প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে এবং গবেষণা করতে হবে। গল্পের মধ্যে নিজস্ব বয়ান তৈরি করতে হবে। ভারতের ক্ষেত্রেও প্রাদেশিক চলচ্চিত্র এটা হয়েছে এবং সেখানে চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছে যা আমাদেরও দরকার।
ড. জাকির হোসেন রাজু, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অফ মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি) বলেন, ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান, বা মুশফিক তৈরি করতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের যে অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, ঠিক সেভাবে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে এবং হয়তো দশ বছর পরে এর ফলাফল পাওয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে ড. সুমন রহমান, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অফ মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম, ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) বলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের দর্শকদের চিনতে ভুল করেছেন। তারা শহরের নিম্মবিত্তকে টার্গেট করে যে সিনেমা বানিয়েছেন তার অনেকটাই বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত শ্রেণী গ্রহন করেনি অশ্লীলতার কথা বলে। তারা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পরিবর্তে কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্র ও চ্যানেল দেখে। তিনি আরো বলেন, বাংলা চলচ্চিত্রকে টিকে থাকতে হলে তার স্থানিক দর্শকদের চাহিদা তৈরি করতে হবে; সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক সাংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে সভাপ্রধানের বক্তব্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম বলেন, বলিউড যদি হলিউডের হেজেমনি সত্ত্বেও টিকে থাকতে পারে, তাছাড়া ফ্রেঞ্চ বা স্পানিশ সিনেমা যদি নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারে তাহলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কেনো ভারতীয় সিনেমার মাঝে টিকে থাকতে পারবে না। তিনি বলেন, সিনেমার মার্কেট হবে ওপেন বুক এক্সামের মতো যেখানে পুস্তক খোলা রাখলেও শিক্ষার্থী তার নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা বা নতুন আইডিয়া ডেভেলপ করবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিকে আকড়ে ধরতে হবে, সেজন্য সিনেমা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২০
এমকেআর