ঢাকা: ‘আজকে...!’ শব্দটা উচ্চারণ করেই থেমে গেলেন ফাল্গুনী হামিদ। চাপা কান্নায় চোখ মোছার দৃশ্য দেখলে খুব সহজেই বোঝা যায়, কথা তার গলা আটকে ধরেছে! তবুও কান্নাকে শিকল পরিয়ে অনেকটা সময় বেদনায় চুপ থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবার উচ্চারণ করলেন-‘আজকে যে কারণে এখানে দাঁড়িয়েছি, সেটি আমাদের জন্যে অত্যন্ত ব্যথার একটি দিন।
কাঁদতে কাঁদতে ফাল্গুনী হামিদ বলেন, 'সাজ্জাদ ভাই আমার স্বামীর বড় ভাই। উনি আমার ভাসুর। কিন্তু আমি কোনদিন ওনাকে ভাসুর ভাবিনি। উনি সবসময় আমার বড় ভাই ছিলেন। কারণ আমার কোনো ভাই ছিল না। আমি এই পরিবারে আসার পর থেকেই ভাইকে আমি বড় ভাই হিসেবে পেয়েছি। তিনি যখন হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন, বারবার ছুটে গিয়েছি, ডাক্তারদের জিজ্ঞাসা করেছি- আমি একটু দেখতে যেতে পারবো ভাইকে? বেশি লোকের ভিড় করা বারণ ছিল আইসিইউতে, তারপরেও গিয়েছি। আমাকে দেখে তখন হাসতে পারছিলেন না, তাও জিজ্ঞেস করছিলেন- ফাল্গুনী তুমি ভালো আছো?'
কথা বলতে বলতে শূন্য থেকে তার দৃষ্টি নেমে এলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি ভবনের বারান্দায়। সেখানে রাখা আছে বিশিষ্ট সংস্কৃতিজন মাহমুদ সাজ্জাদের মরদেহ। তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার আত্মীয়-স্বজন, অসংখ্য গুণগ্রাহী।
ফাল্গুনী হামিদ একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ভাই যত বড় মাপের মানুষ ছিলেন ততো বড় মাপের শিল্পী ছিলেন, সেটা সবাই বলেছেন, সবার তা জানা। কিন্তু উনি, যে হামিদদের পরিবার খুব ধর্মভীরু পরিবার, তারমধ্যে হামিদ এবং সাজ্জাদ ভাই, আমার ছোট দেবর, এরা ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক এক চেতনার মানুষ। বর্তমান সময়ে যেখানে এই সাম্প্রদায়িকতার হানাহানি, সেখানে ভাইকে খুব দরকার ছিল। ’
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদাও বললেন সে কথা। তার মতে- ‘সংস্কৃতি বলতে আমরা যে শুদ্ধাচারের কথা বর্তমানে বলি, বাংলাদেশ এবং সারা পৃথিবীব্যাপী সেই শুদ্ধাচারের এক অনন্য উদাহরণ আমার আড্ডার বন্ধু, সংস্কৃতির বন্ধু মাহমুদ সাজ্জাদ। কিন্তু তাকে এখন আর পাবো না। তার সঙ্গে আড্ডা দিতে হবে সেই অনন্তকালে গিয়ে। ’
মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের অভিনেতা মাহমুদ সাজ্জাদ মারা যাওয়ার পর সোমবার (২৫ অক্টোবর) তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এর আগে রোববার (২৪ অক্টোবর) রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে মাহমুদ সাজ্জাদের বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।
দুপুরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে মাহমুদ সাজ্জাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, আতাউর রহমান, রামেন্দু মজুমদার, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য অসিম কুমার উকিল, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, সংস্কৃতিজন ও মাহমুদ সাজ্জাদের মেজ ভাই ম হামিদ প্রমুখ।
মাহমুদ সাজ্জাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, আমরা নকশী কাঁথা যখন দেখি, তখন শুধু কাঁথাটা দেখি। কিন্তু ওই কাঁথার ভেতর যে শত শত, লক্ষ লক্ষ সুতা এবং সুঁইয়ের কাজ আছে, ছোট ছোট, সেগুলো দেখি না, দেখা হয় না। তো এতগুলো মানুষের অমন অবদান যদি না থাকে তাহলে একটি কাঁথা তৈরি হয় না। তেমনি করে বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং শিল্প ভূবন মাহমুদ সাজ্জাদের মতো হাজারো মানুষের পরিশ্রমের ফসল। এতো নীরবে, এতো নিভৃতে, এটি ভাবা যায় না। যখন প্রথম চলচ্চিত্রে আসলেন, আমরা প্রথম আন্ডার অ্যাক্টিং বলতে যেটা বোঝায়, সেটা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে হাজির হলো। ড্রামাটিক অ্যাক্টিং বাদ দিয়ে একটি উপস্থিতি, যে উপস্থিতির মধ্যে একজনের পরশ আছে, কিন্তু কোনো রকম শব্দস্পর্শ নেই, সেই অভিনয়ের ধারা তিনি আজীবন চর্চা করেছেন। মঞ্চেও করেছেন, টেলিভিশনেও করেছেন।
নাট্যজন আতাউর রহমান বলেন, অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে একাধিক নাটকে অভিনয় করার সুযোগ হয়েছে। চলচ্চিত্রে কাজ করেছি একসঙ্গে। কিন্তু কখনো উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি, এত মিষ্টি মানুষ ছিলেন তিনি। আমাদের বয়সে অনেক ছোট মাহমুদ সাজ্জাদ, তবুও সে তার কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের এবং আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশকেও গৌরবান্বিত করেছে সে।
লিয়াকত আলী লাকী বলেন, এটি অতুলনীয় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের সংস্কৃতির জন্য, প্রতিটা শিল্প পরিবারের জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্য। সংস্কৃতির প্রতি তার যে অনুরাগ, তার জীবনের দিকে তাকালেই আমরা তা দেখতে পাই। এক কথায় একজন শিল্পী হিসেবে তিনি যেমন অসাধারণ, তেমনি একজন মানুষ হিসেবেও তিনি একজন অসাধারণ রকমের সাধারণ মানুষ। তাকে ভাবতে গেলে তার হাসিমুখ ছাড়া অন্যকোন চিত্র যেন আমাদের অনুভবে আর আসে না।
শিল্পকলা একাডেমিতে এ সময় বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক উপকমিটি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমিতি, ডিরেক্টরস গিল্ডস, মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরাম, বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে মরহুমের প্রতি ফুলের শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মাহমুদ সাজ্জাদের মরদেহ তার নিজ গ্রাম ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হবে বলে জানা গেছে।
এর আগে করোনাভাইরাস পরবর্তী জটিলতা নিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় মাহমুদ সাজ্জাদকে। শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকায় দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন>>
অভিনেতা মাহমুদ সাজ্জাদ আর নেই
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০২১
এইচএমএস/এমআরএ