বাগেরহাট: বাগেরহাটে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) নূন্যতম বিপদগ্রস্থের তালিকাভুক্ত বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ “নাগলিঙ্গম” গাছে ফুল ফুটেছে। বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ এলাকায় থাকা সামাজিক বন বিভাগের নার্সারিতে থাকা দুটো গাছে এবার ফুল ফুটেছে।
এদিকে, জেলা জজ আদালত ভবনের পশ্চিম পাশে বাগানের একটি গাছে ফল হলেও জানে না সামাজিক বন বিভাগ। সরকারি এই দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সামাজিক বন বিভাগের ষাটগম্বুজ এলাকার নার্সারিতে দুটি, চিতলমারি নার্সারিতে একটি এবং বাগেরহাট শহরের খারদ্বার এলাকায় থাকা সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে একটি “নাগলিঙ্গম” গাছ রয়েছে। তবে এই কার্যালয়ের প্রধান ফটকের পাশেই আরও একটি বড় গাছ ছিলো। যে গাছটিতে ফুল ও ফলও হত। কিন্তু ফটকের পাশেই নিরাপত্তা চৌকি নির্মাণের অজুহাতে গাছটি কেটে ফেলা হয়েছে।
জানা যায়, সরকারি হিসেবে জেলায় মাত্র চারটি নাগলিঙ্গম গাছ রয়েছে। তবে বিরল প্রজাতির এই গাছটিকে সংরক্ষণ বা এই গাছের বীজ সংগ্রহপূর্বক চারা তৈরি করে ছড়িয়ে দেওয়ার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই সামাজিক বন বিভাগের।
বাগেরহাটে নাগলিঙ্গম গাছের উপস্থিতি সম্পর্কে সামাজিক বন বিভাগের নার্সারিতে কর্মরত প্লান্টেশন মালি মো. মুক্তার হোসেন বলেন, দীর্ঘ কর্মজীবনে বিভিন্ন এলাকায় থাকা সামাজিক বন বিভাগের নার্সারিতে কাজ করলেও, অন্য কোথাও এই গাছ দেখিনি। প্রায় ৩০ বছর আগে কোনো এক কর্মকর্তা বাগেরহাটের গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। এখন আর খুব বেশি গাছ নেই। সব মিলিয়ে ৪-৫টি গাছ থাকতে পারে। এই গাছের পাকা ফলের গন্ধ খুব বাজে। চারা তৈরি করতে হলে, সেই গন্ধ সহ্য করে বীজ সংগ্রহ করতে হয়। বীজের অঙ্কুরদোগমের হারও বেশ কম। এই গাছের সৌন্দর্য ও বিরলতার ব্যাপারে আলোকপাত করে গাছটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক তীর্থংকর বাছাড় বলেন, প্রতিটি উদ্ভিদই প্রাণ-প্রকৃতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি উদ্ভিদের রয়েছে আলাদা আলাদা ভেষজ গুন ও প্রয়োজনীয়তা। ‘নাগলিঙ্গম’ গাছটিও এর ব্যতিক্রম নয়। বাগেরহাটে নাগলিঙ্গম গাছের সংখ্যা খুবই কম। এটি আইইউসিএন এর নূণ্যতম বিপদগ্রস্থের তালিকাভুক্ত উদ্ভিদ। এই গাছটি হারিয়ে গেলে, এর যে দারুণ ভেষজ গুন রয়েছে, তা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। এ কারণে উদ্ভিদটিকে সংরক্ষণ ও বিস্তারের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাজ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সামাজিক বন বিভাগের উপ-বন সংরক্ষক জিএম রফিক আহমেদ বলেন, এই মুহুর্তে আমাদের কার্যালয় ও দুটি নার্সারিতে মোট চারটি নাগলিঙ্গম গাছ রয়েছে। এই গাছগুলোর সংরক্ষণ ও বিস্তারের জন্য আমরা কাজ করছি।
বিরল প্রজাতির হওয়ার পরে প্রধান ফটকের পাশে থাকা “নাগলিঙ্গম” গাছটি কেন কাটা হল এমন প্রশ্নের উত্তরে সামাজিক বন বিভাগের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, নিরাপত্তা কক্ষ করার জন্য গাছটি কাটা হয়েছে। এখনও আমাদের গাছ রয়েছে। চারা তৈরি করে “নাগলিঙ্গম”কে টিকিয়ে রাখা হবে।
জানা যায়, সবুজ পাতার বৃহদাকৃতির গাছ ‘নাগলিঙ্গম’-এর আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বনাঞ্চল। এর ইংরেজি নাম 'cannonball tree' এবং বৈজ্ঞানিক নাম Couroupita guianensis। তবে কেউ কেউ মনে করেন ভারতেই এর উৎপত্তি এবং বিস্তার। বাংলাদেশেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু নাগলিঙ্গম গাছ আছে। তবে তার সংখ্যা খুবই নগণ্য। “নাগলিঙ্গম” প্রায় ৩০-৩৫ মিটার উচু হতে পারে। লম্বাটে ধাঁচের সবুজ পাতাগুলো গুচ্ছ আকারে থাকে। সাধারণত অন্যান্য প্রজাতির গাছের শাখা বা পাতার পাশ থেকে ফুল-ফল জন্মায়। কিন্তু নাগলিঙ্গমের ফুল ও ফল জন্ম নেয় সরাসরি মূল গাছের কাণ্ড থেকে। ফুলের পাঁপড়ির রং লালচে গোলাপী ও কেন্দ্র হালকা গোলাপী। নাগলিঙ্গমের সুবাসের বেশ খ্যাতি রয়েছে। ফুলের ঘ্রাণ অনেকটা শাপলা, পদ্ম ও গোলাপের সংমিশ্রণের মতো। তবে ফলে বেশ বাজে গন্ধ রয়েছে। ফুলের আকৃতি অনেকটা ফণাতোলা সাপের মতো দেখতে হওয়ায়, এর নামকরণ নাগলিঙ্গম হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
বিরল প্রজাতির এ উদ্ভিদের রয়েছে বেশকিছু ঔষধি গুণও। এই গাছের বাকল, ফুল ও পাতার নির্যাস দিয়ে তৈরি করা যায় এন্টিসেপটিক, এন্টিফাঙ্গাল ও এন্টিবায়োটিক। ম্যালেরিয়া উপশমেও এর পাতা ব্যবহায় হয় দক্ষিণ আমেরিকাতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৯ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০২৩
এসএম