ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ চৈত্র ১৪৩১, ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

আসাদুলের মেয়েরা কি আর স্কুলে যেতে পারবে

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০২৫
আসাদুলের মেয়েরা কি আর স্কুলে যেতে পারবে

সাতক্ষীরা: জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে বসতবাড়ি। অবশিষ্ট ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে মাথায় হাত দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আসাদুল ইসলাম।

কোথায় যাবেন, কী করবেন, কীভাবেই বা মেরামত করবেন বসতবাড়ি, সেই চিন্তায় বিভোর তিনি।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট গ্রামের জামের আলী মোড়লের ছেলে আসাদুল পেশায় একজন দিনমজুর। বাবা-মা, চার ছেলে-মেয়ে ও স্বামী-স্ত্রী মিলে আটজনের সংসার তার।

আসাদুল ইসলাম বলেন, ঈদের দিন সকালে খবর পাই বিছট স্কুলের পাশে বাঁধ বসে গেছে। মসজিদের মাইক থেকে এ ঘোষণা শুনে সবাই সেখানে গিয়ে বাঁধটা রক্ষার চেষ্টা করি। কিন্তু দুপুরের জোয়ারের তোড়ে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। বাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে বিছট, বল্লবপুর, আনুলিয়া, চেচুয়া ও কাকবাশিয়া গ্রামের আংশিক প্লাবিত হয়। এছাড়া নয়াখালী পুরোপুরি ভেসে যায়। ঘরে কোমর সমান পানি ওঠে। উপায়ন্ত না পেয়ে ছেলে-মেয়েদের আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। আমরা আশ্রয় নিই রাস্তার ওপর। কোনো কিছুই রক্ষা করা সম্ভব হয়নি, ঘরের দেয়াল পড়ে গিয়ে প্রতিদিন দুই বার জোয়ার-ভাটায় সব কিছু টেনে নিয়ে গেছে। এখন আব্বা-মাকে থাকতে দেব কোথায়? ছেলে-মেয়েদের রাখবো কোথায়? আর আমরা থাকবো কোথায়? প্রশ্ন করেন তিনি।

তিনি বলেন, আমার চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণি ও মেজ মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তারা কি আর স্কুলে যেতে পারবে? এসময় কবে নাগাদ ঘরবাড়ি আবার ঠিক করতে পারবেন তা নিয়ে রীতিমত বিলাপ করতে শুরু করেন আসাদুল।

গত ৩১ মার্চ পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছটে খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ায় আসাদুল ইসলামের মতো ঘরবাড়ি হারিয়েছেন আরও অনেকে। এসব পরিবারে এখন বিষাদের ছায়া।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার উপকূলের মানুষের প্রশ্ন- আর কতবার বাড়িঘর হারাবেন তারা?

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে বার বারই উঠে আসছিল নয়াখালীর কথা। বিছটের ভাঙন পয়েন্ট থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে নয়াখালী। গ্রামটিতে যেতেই ছুটে আসে বিকট দুর্গন্ধ। চারদিনের জোয়ারভাটায় দূষিত হয়ে গেছে গ্রামের সব জলাশয়। আটকে থাকা দূষিত পানির মাধ্যমে নয়াখালীতে ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগ বালাই।

নয়াখালীর বয়োবৃদ্ধ মর্জিনা বেগম জানান, ঈদের দিন সকালে দুই রাকাত নামাজ পড়ার পর থেকে গত কয়েকদিন আর নামাজ পড়তে পারেননি তিনি। সবাই আশ্রয় নিয়েছেন বেড়িবাঁধের ওপর। সেখানেই পলিথিন টাঙিয়ে দিনরাত কাটছে তাদের।

এ গ্রামেরই বাসিন্দা পলাশ হোসেন স্ত্রী সেলিনা পারভীন।  
নয়াখালী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ধসে পড়া ঘর থেকে দশম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলের ভিজে যাওয়া বইপত্রের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাতা কুড়িয়ে শুকাতে দিচ্ছেন সেলিনা। বললেন, সব হারিয়ে আমরা এখন নিঃস্ব। বাঁধের ওপর পলিথিন টাঙিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। কবে নাগাদ ঘরে ফিরতে পারব- তা আল্লাহ জানেন।    

নয়াখালীর ইমদাদুল শেখ জানান, তাদের গ্রামে অন্তত ১৫০টি পরিবারের বসবাস। ছোট্ট এ গ্রামটির প্রায় ১০০ কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। ইটের ঘরগুলো না পড়লেও প্লাবিত হওয়ায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখন তারা সবাই বাঁধের বাসিন্দা।

তিনি বলেন, নয়াখালী গ্রামের টয়লেটগুলো সব ভেসে গেছে। পানি দূষিত হয়ে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

চেচুয়ার আমেনা বেগম বলেন, লবণাক্ত এলাকা হওয়ায় এমনিতেই এখানে খন্দপাতি (শাক-সবজি) হয় না। তার পরও বহু কষ্টে বাড়ির উঠানে কিছু শাক-সবজির চারা দেওয়া হয়েছিল। সব মরে বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। যেসব জমিতে ধান লাগানো হয়েছিল তাও পচে গেছে। লোনা পানি খেয়ে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল মরে যাচ্ছে।

এদিকে বিছটের ভাঙনকবলিত এলাকায় শুক্রবারই রিং বাঁধ দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢোকা বন্ধ করতে পেরেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে, এখনো রিং বাঁধের বাকি কাজ চলছে। অন্যদিকে সরকারি কর্তৃপক্ষসহ নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে দুর্যোগকবলিত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা চালানো হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ ভ্রাম্যমাণ প্লান্টের মাধ্যমে নয়াখালীতে সুপেয় পানি সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে।

কিন্তু ভাঙনের প্লাবনে ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়া মানুষ কবে নাগাদ ফিরতে পারবেন স্বাভাবিক জীবনে সেই প্রশ্নই ভেসে বেড়াচ্ছে নয়াখালী, বিছট, বল্লবপুর, আনুলিয়া, চেচুয়া ও কাকবাশিয়া গ্রামের আকাশে বাতাসে।  

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০২৫
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।