ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনা গিলে খাচ্ছে শাহ সিমেন্ট। সিমেন্ট ফ্যাক্টরির আড়ালে দিনের পর দিন মাটি ফেলে ভরাট করে দখলে নিচ্ছে নদী।
নথি অনুযায়ী, মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে শাহ সিমেন্টকে ‘দখলদার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু নদীগুলো রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। নথিপত্র অনুযায়ী, শাহ সিমেন্ট ২০০২ সালে কারখানাটি নির্মাণ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই কারখানা বিস্তৃত হয় দুই নদীর ভিতরে।
কোম্পানিটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, শাহ সিমেন্টের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা এক কোটি টন। সরেজমিনে দেখা যায়, বিশাল স্থাপনা, ভারী যন্ত্রপাতি এবং একটি গুদাম দাঁড়িয়ে আছে দুই নদীর মোহনাস্থলে। মুন্সিগঞ্জ সদর সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিসও নিশ্চিত করেছে, শাহ সিমেন্ট মিরেরসরাই মৌজায় আরএস দাগ নম্বর ১৮৪ এবং পূর্ব মুক্তারপুর মৌজায় আরএস দাগ নম্বর ৩০১ থেকে ৩০৮ পর্যন্ত একটি বড় নদী এলাকা দখল করে রেখেছে।
মুন্সিগঞ্জ ভূমি অফিসের রিভিশনাল সার্ভে (আরএস) রেকর্ড অনুযায়ী, দাগ নম্বর ১৮৪ এবং ৩০১ থেকে ৩০৭ নম্বর দাগ নদী ও নদীর তীর হিসেবে চিহ্নিত এবং ‘বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত। আরএস দাগ নম্বর ৩০৮-এর জমির রেকর্ড সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। দুই দশক আগে এই সিমেন্ট কারখানাটি স্থাপনের আগে ধলেশ্বরী ছিল একটি জীবন্ত নদী। স্থানীয়রা সেখানে মাছ ধরত, গোসল করত এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য নদীর ওপর নির্ভরশীল ছিল।
মুন্সিগঞ্জের নদীপাড়ের গ্রাম মোল্লারচরের বাসিন্দারা জানান, প্রথমে কারখানাটি ছোট্ট একটি জায়গায় গড়ে ওঠে। কিন্তু প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে নদীতে বালু ফেলে ধীরে ধীরে তারা জায়গা বাড়াতে থাকে। রাতের আঁধারেও সেই কাজ চলত। চলতি বছরের ৪ মার্চ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনকে দেওয়া এক চিঠিতে জানায়, শাহ সিমেন্টের বালু ফেলার কার্যক্রম শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীপথে নাব্যতা সংকট সৃষ্টি করছে, নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ব্যাহত করছে এবং পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। চিঠিতে বলা হয়, শাহ সিমেন্টসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোহনায় বালু ও মাটি ফেলে জায়গা উঁচু করছে, যার ফলে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জাহাজ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, সরকারি নির্দেশনা সত্ত্বেও শাহ সিমেন্ট এখনো অবৈধভাবে ফেলা বালু ও মাটি অপসারণ করেনি। এই কর্মকাণ্ড বন্দর আইন ১৯০৮, বন্দর বিধিমালা ১৯৬৬ এবং উচ্চ আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সাম্প্রতিক এক সফরে এলাকাটি পরিদর্শন করে অবৈধ দখল নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। দুই বছর আগে ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন একটি তালিকা প্রস্তুত করে এবং শাহ সিমেন্টকে নদী দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টরের সই করা ওই তালিকা অনুযায়ী, ১৫টি প্রতিষ্ঠান ধলেশ্বরী নদীর ৩৪ দশমিক ৯৬ একর জায়গা দখল করেছে। এর মধ্যে শাহ সিমেন্ট একাই দখল করেছে ২৪ একর। এখানে তারাই সবচেয়ে বড় দখলদার। এর আগে ২০১৯ সালের ৬ মে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন একটি তালিকা তৈরি করে এবং ৫০টি নদী দখলকারীর মধ্যে শাহ সিমেন্টকে অন্তর্ভুক্ত করে। সেখানে বলা হয়, কোম্পানিটি মিরেরসরাই মৌজায় আরএস দাগ নম্বর ১৮৪-এর নদীর জমি দখল করেছে।
তৎকালীন জেলা প্রশাসকের সই করা চিঠিতে বলা হয়, এই তালিকাটি সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে, নোটিস প্রদান ও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে। চিঠিটি দেশের সব নদীর আইনি অভিভাবক জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছেও পাঠানো হয়েছিল। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনও ২০১৮ ও ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে শাহ সিমেন্টকে এই দুই নদীর দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে।
২০১৮ সালের প্রতিবেদনে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জানায়, শাহ সিমেন্ট ‘ধীরে ধীরে নদীর জমি দখল করে ভরাট করছে এবং নদীর চরের জায়গায় সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে। ’ পরের বছর ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, শাহ সিমেন্ট কোম্পানি মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার মিরেরসরাই মৌজায় আরএস খতিয়ান নম্বর এক ও আরএস দাগ নম্বর ১৮৪-এ নদীর প্রায় ২৪ একর জায়গা বালু ফেলে ভরাট করে দখল করেছে। জমির শ্রেণি পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে বালু ফেলার মাধ্যমে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কোম্পানিটি বিশাল কারখানা নির্মাণ করেছে, যার ফলে একদিকে ধলেশ্বরী এবং অন্যদিকে শীতলক্ষ্যা নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যা দুটি নদীকেই গিলে ফেলার আশঙ্কা তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, কারখানাটি ধলেশ্বরী নদীতে তরল ও কঠিন বর্জ্য ফেলে।
এতে বলা হয়, এই কারণে নদীর পানি, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় চার মিটার ব্যাসের একটি বড় পাইপ দিয়ে শাহ সিমেন্ট কারখানা থেকে সরাসরি দূষিত পানি নদীতে গিয়ে পড়ছে; ফ্লাই অ্যাশের দূষণে মাছ ও পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে গেছে।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, শাহ সিমেন্ট ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর থেকে নারায়ণগঞ্জ বিআইডব্লিউটিএ পোর্ট অফিসের লাইসেন্সে নদীর তীরবর্তী জমি ব্যবহার করছে, যা কারখানা স্থাপনের দুই বছর পর শুরু হয়।
বর্তমানে কোম্পানিটির কাছে ১১ দশমিক ২৮ একর নদীর তীরবর্তী জমির ইজারা রয়েছে, যার মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হচ্ছে। ইজারা চুক্তি অনুযায়ী, কোম্পানিটি নদী বা নদী-তীরবর্তী জায়গা ভরাট করতে পারবে না, অতিরিক্ত নদীর জমি ব্যবহার করতে পারবে না, নদীতীর পরিবর্তন করতে পারবে না, নাব্যতা ব্যাহত করতে পারবে না, ইচ্ছামতো জাহাজ ভেড়াতে পারবে না এবং নদীতে বর্জ্য ফেলতে পারবে না। কিন্তু সব নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে নদী দখল।
এসআই