মঠবাড়ি, কয়রা, খুলনা থেকে: পুরুষেরা গাছকাটা-গোলপাতা কাটা, কাঁকড়া ধরা আর মধু আহরণে ব্যস্ত। অন্যদিকে নারীরা ব্যস্ত থাকেন চিংড়ির পোনা ধরায়।
এত পরিশ্রমের পরেও সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলোর বনজীবীদের কষ্ট যেন ফুরায় না। পরিবারের সবাই মিলে কঠিন সংগ্রাম করেও তিনবেলা ভাত জোটাতে না পেরে বনজীবীদের অনেকে আবার ফিরছে অন্য কাজে। কেউ এলাকায়, আবার কেউ দূরের শহরে।
কয়রা উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে মঠবাড়ি গ্রাম। কাঁচা রাস্তা দিয়ে এ গ্রামে ঢুকতেই নারী-পুরুষের ভিড় জমে যায়। সবার মুখেই বনজীবীদের বেঁচে থাকার কষ্টের কথা। সরকারের নানা নিষেধাজ্ঞা আর প্রাকৃতিক নানা কারণে বন এখন আর তাদের জীবিকার পথ দেখাতে পারছে না।
যেসব গ্রামের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বাপদাদার আমল থেকে থেকে বনের কাজে জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে তাদের অধিকাংশই বছরের বেশিরভাগ সময় কর্মহীন থাকে।
খুলনা শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা কয়রার। ওপারে সুন্দরবন, এপারে লোকালয়, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে কম প্রশস্থের ছোট্ট নদী শাকবাড়িয়া।
এ নদীর পারে সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম মঠাবাড়ি, কাশিয়াবাদ, কয়রা চার নম্বর, পাঁচ নম্বর, ছয় নম্বর, পাথরখালী, মাটিকাটা, গাববুনিয়া, শাকবাড়িয়া, হরিহরনগর, গাতিঘেরি, বীনাপানি, জোড়শিং, আংটিহারা, গোলখালী ঘুরে বনজীবীদের জীবন সংগ্রামের নানা তথ্যচিত্র নজরে আসে।
বহু কর্মহীন মানুষকে গাছের ছায়ায়, দোকানে, রাস্তার ধারে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। বনের কাজ ছেড়ে অনেকে মাটিকাটা, নদীভাঙন রোধে ব্লক বানানো, বালুর বস্তা নদীতে ফেলা ছাড়াও নানা কাজ করছে। তবে এতে মজুরি একেবারেই সামান্য।
ভর দুপুরে শাকবাড়িয়া গ্রাম থেকে হরিহর নগরের দিকে যাওয়ার সময় পথে দেখা কৃষ্ণপদ মন্ডল আর চপল পাইনের সঙ্গে। পাশের গ্রামের কোনো এক বাড়িতে চুক্তিভিত্তিক একবেলা কাজ শেষে কাঁধে কোদাল নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন।
কৃষ্ণপদ মন্ডল আর চপল পাইন বাংলানিউজকে বললেন, কখনো কারো বাড়িতে, কখনো চিংড়ির ঘেরে আবার কখনো বনের কাজে যান। কিন্তু এ দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল। আবার কাজেও নেই কোনো নিশ্চয়তা। অতিকষ্টে কাজ যোগাড় করতে পারলেও মজুরি যৎসামান্য। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করেও দেড়-দুইশ টাকার বেশি পাওয়া যায় না।
গাববুনিয়ায় নদীর পারের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাটি কাটার দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করার সময় সংবাদকর্মী বুঝতে পেরে একজন চিৎকার করে বলছিলেন, ভাই গাছের কথা কিছু ল্যাখেন। আমরা খালি এ জঙ্গলডার লইগ্যা বাঁইচ্যা আছি। হেই জঙ্গল কাইটা শেষ কইরা দিচ্ছে। এ কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে বনের গাছ চোরদের দুটো নৌকা দ্রুতবেগে লোকালয়ে ঢুকছে।
এলাকার মানুষ জানালেন, এভাবেই দিনের বেলায় কাঠ চোরেরা বন ধ্বংস করছে। অথচ বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের নিরীহ মানুষদের সেখানে যেতে নানা সমস্যা। বনে বন দস্যুদের আতঙ্ক, বাঘের ভয়।
তার ওপর বন বিভাগের অপতৎপরতাও আছে। নিরীহ বনজীবীরা বনে পারমিট নিয়ে গেলেও বনরক্ষীদের টাকা দিতে হয়। আর পারমিট না থাকলে এ টাকার পরিমাণ একটু বেড়ে যায়।
কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের ডেপুটি রেঞ্জার মো. আলাউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, এ অভিযোগ সত্য নয়। পারমিটধারী বনজীবীরা কোনো বাধা ছাড়াই বনে কাজ করতে পারেন।
সূত্র বলছে, সুন্দরবনের গা ঘেঁসে জেগে থাকা এ গ্রামগুলোর মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভর করে বনের ওপর। বনে প্রধান কাজগুলোর মধ্যে আছে মাছধরা, কাঁকড়া ধরা, গাছকাটা, গোলপাতা কাটা ও মধু আহরণ।
এ ছাড়াও বনের ভেতরে ও আশাপাশের নদীতে স্থানীয়রা চিংড়ির পোনা ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে আবার মৌসুম ভিত্তিতে এসব কাজ করে। হয়তো বছরের তিন মাস বনে কাজ করে, বাকি সময় ফেরে অন্য কাজে।
পাঁচ নম্বর কয়রা এলাকার বাসিন্দা খলিল ঢালী প্রায় ২৫ বছর ধরে সুন্দরবনে মধু আহরণ করে। তিনি জানান, বাংলা সনের চৈত্র মাসের ১৮ তারিখে মধু আহরণকারীদের পারমিট দেওয়া হয়। আট জনের একটি দল একমাসের জন্য মধু আহরণে যায়। এক মাস পর পর ১৫ দিন করে বন্ধ রেখে বছরে তিন মাস মধু আহরণের সুযোগ আছে।
কয়রার কাশিয়াবাদ ও মঠবাড়ি গ্রামে চোখে পড়ে বনজীবীদের বিপন্ন বসতি। শাকবাড়িয়া নদীর ভাঙনে এখানকার মানুষদের তাড়িয়ে ফেরে। বহু মানুষ ঘূর্ণিঝড় আইলার পর নির্মিত নতুন বাঁধের ভেতরে ও বাইরে আশ্রয় নিয়েছে। বাঁধেল দুধারে সারি সারি ছোট ঘর। কোনোমতে জীবন ধারণ। পানির কষ্ট, খাবারের কষ্ট, চিকিৎসার কষ্ট এ মানুষগুলোর নিত্যসঙ্গী।
বনজীবীদের এসব গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় না। যে বয়সে ওদের স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই শিশুকাল থেকেই ওরা শুরু করে বনের প্রশিক্ষণ। কারণ, ওদের বাবা-মা, দাদা সবাই যে বনজীবী। ভবিষ্যতে হয়তো এ পেশাই ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে!
বাংলাদেশ সময়: ০৫৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/জিসিপি