ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

দুঃখ যাদের পিছু ছাড়ে না

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৩
দুঃখ যাদের পিছু ছাড়ে না

Rafiqul-islamদক্ষিণ বেদকাশী (কয়রা, খুলনা) ঘুরে এসে: দুস্থ-অভাবী যেসব নারী পরিবারের প্রধান, দুঃখ তাদের পিছু ছাড়ে না। এখানে ওখানে চেয়েচিন্তে খাওয়া, ধারকর্জ করে চলা, সাহায্যের জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় তাদের নিত্যই বাড়াতে হয় হাত।

তবুও আটার রুটি-পায়েশ খেয়ে জীবন ধারণ, কখনো অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটানো। দুস্থ এই নারীদের সংসার চালিয়ে নিতে সরকারি সাহায্য থাকলেও তা পাওয়ার সৌভাগ্য হাতে গোনা কয়েকজনের।

কয়রা উপজেলার সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলোতে এমন বহু নারীর দেখা মেলে। যাদের জীবন চলছে ধুঁকে ধুঁকে। কারও স্বামী মারা গেছে, কারো কারো স্বামী তাদের ফেলে রেখেই চলে গেছে, আবার কারো স্বামী কঠিন অসুখে অথর্ব অচল হয়ে ঘরে পড়ে আছে। স্বামীর অনুপস্থিতি কিংবা অবর্তমানে এই নারীরা হয়ে উঠেছেন পরিবারের প্রধান। সন্তান লালন-পালন থেকে শুরু করে রোজগার করা, বাজার সওদা করা, সবই এই নারীদের কাজ।
DSC-1
এ ধরনের দুস্থ নারীদের জন্য সরকার ভিজিডি বরাদ্দ দিচ্ছে। দুই বছর মেয়াদে প্রতি মাসে ত্রিশ কেজি করে চাল কিংবা গম দেওয়া হয়। কিন্তু ভিজিডি তালিকায় খুব কম সংখ্যক দুস্থ নারীরই নাম ওঠে। একটি ইউনিয়নে দুই থেকে আড়াই হাজার দুস্থ নারী থাকলেও সেখানে বরাদ্দ পাওয়া যায় মাত্র দুই-আড়াইশ জনের।

অন্যদিকে, এই ভিজিডি চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগও আছে। ৩০ কেজির স্থলে কেউ পান ২২ কেজি, আবার কেউ ২৫ কেজি।

দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভিজিডি বিতরণের দিন গিয়ে দেখা গেছে, মাস শেষে এই বরাদ্দটি নিতে দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় জমিয়েছেন বহু নারী। কেউ নিজেই এসেছেন, আবার কেউবা পাঠিয়েছেন স্বজনদের। এভাবেই দেওয়া হচ্ছে গম।

অপেক্ষমান নারীদের একজন ঘাটে বাঁধা নৌকায় উঠছেন, বস্তায় ভরে গম নিচ্ছেন, আবার আরেকজন যাচ্ছেন। এভাবে দীর্ঘ সময়ে বিতরণ শেষ হয়। বিতরণের সময়ই অনেকের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেলো, ৩০ কেজি বরাদ্দ থাকলেও ওজনে কম দেওয়ার।
DSC-3
এই অভিযোগ প্রসঙ্গে দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বাংলানিউজকে বলেন, কখনো কখনো দু’এক কেজি কম পড়তে পারে। তবে সেটা আমাদের গাফিলতি নয়। গুদাম থেকে আমরা যেটা কম পাই, সেই ঘাটতিটুকুই এদের প্রতি বস্তায় কম পড়ে।

ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানায়, স্বামী নেই কিংবা পরিত্যক্তা, আয়ের পুরুষ সদস্য নেই, নারীই পরিবারপ্রধান, এমন নারীদের সংখ্যা ইউনিয়নে প্রায় আড়াই হাজার। কিন্তু দুস্থ-অভাবী নারীর তালিকায় নাম রয়েছে মাত্র ২২৬ জনের। বাকিদের সহায়তার কোনো সুযোগ পরিষদে নেই। ফলে তাদের দিন কাটে অতি কষ্টে।

আংটিহারা গ্রামের মাহফুজা বেগমের স্বামী শহিদুল ইসলাম তাকে ফেলে চলে গেছে তিন বছর আগে। নয় বছরের একটি ছেলে আছে সংসারে। তাকে নিয়েই এখন থাকেন বাবার বাড়িতে। দুস্থ নারী হিসেবে ভিজিডি তালিকায় নাম আছে তার। এই সাহায্য তার সংসার চালাতে অনেকখানি সহায়তা করে। তারপরও তাকে কাজ করতে হয় বাইরে। প্রতিনিয়ত কাজের সন্ধানে ছুটতে হয়।
DSC-22
মাটিয়াভাঙার কাকলী রানী বাইনের স্বামী কীর্তিবাস বাইন বেঁচে আছেন ঠিকই। তবে প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে কাজ করতে পারেন না। তাই তার নাম দুস্থ তালিকায়। ভিজিডি সাহায্য হিসেবে পাওয়া গম মেশিনে আটা করে বাড়ি ফেরেন তিনি। আটার রুটি কিংবা আটা দিয়ে এক প্রকার ভাত বানিয়ে খান। এই সাহায্য দিয়ে তার চলে ১২-১৪ দিন মাত্র। হাড়ভাঙা খাটুনি ছাড়া কোনো পথ নেই তার সামনে।

গোলখালীর ফরিদা পারভীন, আংটিহারার আনোয়ারা বেগম, শেফালি বেগম, শাকবাড়িয়ার নুরুননাহারের মত অনেক দুস্থ নারী আছেন যারা কোনো সাহায্যই পান না।

হাফেজ উদ্দিন গাজীর স্ত্রী নুরুননাহারের সঙ্গে শাকবাড়িয়ায় দেখা। চিংড়ির পোনা ধরতে নদীতে যাচ্ছিলেন। স্বামী ফেলে চলে গেছে। দুই ছেলে এক মেয়ে তার। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এক ছেলে নুরুননাহারের কাছে থাকে। ছেলেকে নিয়েই তার সংসার চলছে অতি কষ্টে।              

কয়রার সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলোর যেখানেই খোঁজ নিই। দেখা মেলে এমন দুস্থ-অভাবী নারীদের। সামাজিক নানা সমস্যা তাদের ওপর বোঝা হয়ে আছে। এই নারীদের অধিকাংশের বিয়ে হয়েছে অল্প বয়সে। অনেকেই লেখাপড়ার সুযোগ পান নি। সামাজিক ন্যায়বিচার থেকে বার বার বঞ্চিত হয়েছেন। এক পর্যায়ে স্বামী হারিয়ে হয়েছেন পরিবারের প্রধান। সেই সঙ্গে সংকটও তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছে।     

বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।