ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

সুন্দরবনের দস্যু, বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৩
সুন্দরবনের দস্যু, বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর

চাঁদনিমুখা, গাবুরা (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) ঘুরে এসে: সুন্দরবনের অলিগলিতে দাপিয়ে বেড়ানো দস্যুরা বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। বনে ছোট নৌকা নিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে গেলেই ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিতে হয়।

টাকা পাঠানোর সহজ পদ্ধতি মোবাইল ফোনের মাধ্যম। কখনো কখনো পোস্ট অফিসের অনলাইন। মাছধরা জেলেদের দল থেকে একেক জনকে আটকে রেখে আদায় করা এ মুক্তিপণ।

কয়রা ও শ্যামনগরের সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলোতে কান পাতলে শুধুই জনদস্যুদের আতঙ্ক। বনজীবীরা বনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারানোর বিষয়টিকে ভাগ্যের ব্যাপার হিসেবে মেনে নিলেও দস্যুর অত্যাচারকে মানতে পারেন না। তাদের অভিযোগ, এক শ্রেণীর প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দস্যুরা বছরের পর বছর বনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিরোধে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি তাদের।

গাবুরার নাপিতখালী থেকে চাঁদনিমুখা যাওয়ার পথে দস্যুদের মুক্তিপণ আদায়ের শিহরণ জাগানো গল্প শোনালেন আবুল কালাম। মাত্র কয়েকদিন আগে দস্যুদের কবলে পড়ে তিনি সর্বস্ত হারিয়েছেন। আবুল কালামসহ তিন জেলে নৌকায় সুন্দরবনের ভেতরে ছোট খালে মাছ ধরছিলেন। দু’পাশ দিয়ে ডাকাতের দল তাদের ঘিরে ফেলে। কালামকে আটকে রেখে অন্যদের ছেড়ে দেয়। বিকাশের মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা পাঠালে তিনদিন পর কালাম ছাড়া পান।

এলাকাবাসী জানান, এক সময় সুন্দরবনের এপারের গ্রামগুলো থেকে বাড়িতে এসে দস্যুরা টাকা পয়সা লুট করে নিয়ে যেতো। ডাকাতির পর একজনকে ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করতো। এখন লোকালয়ে এসে ডাকাতির প্রবণতা কিছুটা কমলেও বনের ভেতরে দস্যুদের দাপট কমেনি। এপারের কিছু লোক ডাকাতদলে রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

নাপিতখালীর বাসিন্দা আবদুস সবুর তার চাচা রূপচাঁদ গাজীকে দস্যুরা উঠিয়ে নেওয়ার গল্প শোনাচ্ছিলেন। ডাকাতেরা ১০ লাখ টাকা নিয়ে যেতে বললে শেষ পর্যন্ত ৭০ হাজার টাকা দিয়ে তাকে মুক্ত করা হয়। এছাড়াও ডাকাতদলের ৩০ জনের প্রত্যেককে একটি করে লুঙ্গি, গেঞ্জি ও টর্চ দিতে হয়েছে। একইভাবে এই এলাকার মাহাতাবউদ্দিনকে উঠিয়ে নিয়েছিল ডাকাতরা। ৮০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি।

নাপিতখালীর বনজীবীরা বলেন, ডাকাতের আক্রমণে বারবার মুক্তিপণ দিতে দিতে আমরা এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। অনেক টাকা দেনা হয়ে গেছি। শুধু রাতে নয়, দিনেও ডাকাতেরা নৌকা আটক করে। তাই বনে যেতে ভয় হয়। বনে যে কত ডাকাত আছে হিসাব নেই। যতো গাছ ততো ডাকাত। বনে গেলে আর রক্ষা নেই। বনে কাজ করে আর জীবন চালানোর সুযোগ নেই।

সূত্র বলছে, প্রায় ১৫টি দস্যু বাহিনী গোটা সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিটি বাহিনী এক একজন সর্দার নিয়ন্ত্রণ করে। বাহিনীগুলোর মধ্যে নাছির বাহিনী, আলম বাহিনী, জলিল বাহিনী, রাজু বাহিনী, বাকীবিল্লা বাহিনী, মোতালেক বাহিনী, তসলিম বাহিনী, জুলফিকার আলী গামা বাহিনী, আসাদ বাহিনী, সুমন বাহিনী, মাসুম বাহিনীর নাম উল্লেখযোগ্য।

এরা বনের নির্দিষ্ট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। জেলে, বাওয়ালী, মৌয়ালীসহ অন্যান্য সম্পদ আহরণে গেলে যে কোন বাহিনীর কবলে পড়ে।

শ্যামনগরের চাঁদনিমুখা, নাপিতখালী, পারসেমারী, কয়রার গোলখালী, আংটিহারা, শাকবাড়িয়া গ্রামের লোকজন বলেন, এপারের কিছু ভদ্রবেশী বাসিন্দা সুন্দরবনে দস্যু দলে রয়েছে। এরা রাতে জেলেদের আটক করে, আর দিনে এপারে এসে প্যান্ট-শার্ট পড়ে ঘুরে বেড়ায়। দস্যুতার মাধ্যমে অনেকে আবার কোটি কোটি টাকা কামিয়ে শহরে বাড়ি করেছেন।   চাঁদনিমুখার ডাকাত আনিসুলের কিছুই ছিল না, এখন খুলনায় তার বাড়ি রয়েছে।

গাবুরা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার নবীন্দ্র নাথ মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, বন এই এলাকার মানুষের জীবিকার প্রধান ক্ষেত্র। বনের ওপরই তারা নির্ভরশীল ছিল। কাজ করতে পারতো নির্বিঘ্নে। কিন্তু এখন সে সুযোগ আর নেই। দস্যুরা তাড়িয়ে ফেরে বনজীবীদের। ভয়ে অনেকে এখন আর বনে যায় না।

কয়রার কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের ডেপুটি রেঞ্জার মো. আলাউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, দস্যুদের কাছে বনবিভাগের কর্মীরা অসহায়। দস্যুদের শক্তিশালী অস্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে না বন কর্মীরা। একদিকে বন বিভাগের লোকবল কম, অন্যদিকে অস্ত্র ও যানবাহনের অভাব রয়েছে।

সুন্দরবনের বনদস্যুদের বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হলেও তাদের দাপট কমেনি, বরং বেড়েছে। আগে রাতে জেলেদের আটক করতো। এখন দস্যুদের অভিযান চলে দিনেও। আর এদের দাপটে বহু বনজীবী কর্মহীন হয়ে বিকল্প উপায়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছে।      

বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।