ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

চাষ করে চাষি, ধান নেয় দস্যু

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৩
চাষ করে চাষি, ধান নেয় দস্যু

চর এলাহী, কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী থেকে: অক্লান্ত পরিশ্রমের পূঁজিতে জমি চাষ করে চাষিরা। কিন্তু পাকা ধান ওঠে দস্যুদের গোলা ঘরে।

এটাই নিয়ম হয়ে উঠেছে। আমন আবাদ মৌসুমে জমি চাষের সময় একদফা চাঁদাবাজি। আবার ধান পাকার পর পুরোটাই চর নিয়ন্ত্রণকারীদের দখলে চলে যায়।

এ আধিপত্যের বিরুদ্ধে সাধারণ চাষিদের কথা বলার মতো কোনো অবস্থা নেই। এমনকি জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসন অবধি সবাই দস্যু বাহিনীর কাছে অসহায়।

ধানকাটা মৌসুম শুরু হতে না হতেই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চর এলাকায় দস্যুদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েন চাষিরা। ধারদেনা করে অতিরিক্ত খাটুনি খেটে আমন চাষের পর পাকা ধানের অপেক্ষায় চেয়ে থাকলেও সে ধান তাদের ঘরে উঠছে না। শুধু ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল চাষিরা সব হারিয়ে পথে বসছে। যে ধান তাদের সব স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু। সেই ধান শেষমেশ ঘরে উঠছে না।

সরেজমিনে চর এলাকা ঘুরে জানা গেছে, এবার ধানকাটা মৌসুমের শুরু থেকেই চরের চাষির জমিতে দস্যুদের আনাগোনা শুরু হয়। একের পর এক অব্যাহত থাকে চরাঞ্চলে কৃষকদের আমন ধান লুট। এ অবধি আনুমানিক ১৫ হাজার মণ ধান লুট করেছে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার উড়িরচরের দস্যুরা। বেশিরভাগ ধান লুট হয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে। আবাদ মৌসুম থেকেই দস্যু বাহিনীর নজরে আসে চরের জমির ধান। অপেক্ষায় থাকে কখন পাকবে ধান।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, চলতি মৌসুমে প্রথম দফায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর উমেদ গ্রামের চার খালের ঘাট এলাকা থেকে চাষিদের প্রায় সাড়ে তিন হাজার মণ ধান লুট করেছে দস্যুরা। দ্বিতীয় দফায় আরও প্রায় ছয় হাজার মণ ধান লুটে নেয় তারা।

চর এলাহী গ্রামের বাসিন্দা স্বপনের ১৫শ’ মণ, রেনু চেয়ারম্যানের ৪শ’ মণ, আবুল কালামের ২শ’ মণ, হেদায়েত উল্যার ৯শ’ মণ, মাহাফুজুর রহমানের ৩শ’ মণ, নূর নবীর ৮শ’ মণ, শহীদ উল্যা সবুজের ২শ’ মণ, শহীদ উদ্দিন বাবুলের আড়াইশ মণ, খালেক মিয়ার ৩শ’ মণ, হানিফ চেয়ারম্যানের ৬শ’ মণ, নবী মিয়ার ৬শ’ মণ ধান লুট করেছে জাসু বাহিনীর দস্যুরা।

চর এলাহীর অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, সেখানকার সাবেক চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম চরের ৮০ একর জমিতে ধান আবাদ করেছিলেন। ক্ষেত থেকে ধান কেটে মাড়াইয়ের পর নৌকায় নিয়ে আসার পথে প্রায় ৮শ’ মণ ধান লুট করা হয়েছে।

একই এলাকার বসু মিয়া নিজের ও অন্যের জমি মিলিয়ে ৮০ একর জমিতে আমন আবাদ করেছিলেন। এ জমি আবাদের জন্য ঋণ নিয়েছিলেন প্রায় ৮ লাখ টাকা।

ধান কেটে মাড়াই করে এলাকায় নিয়ে আসার পথে প্রায় ২২শ মণ ধান লুট হয়। এভাবে সবুজ মিয়ার ৮শ’ মণ, স্বপন মিয়ার ৯শ’ মণ, আইউব আলী মাস্টারের ১২শ মণ, হেদায়েতউল্লাহর ৪শ মণ, পরেশ চন্দ্র দেবনাথের ২শ’ মণ, আবদুল্লাহর ২শ’ মণ ধান লুট হয়।

একটি সূত্র জানায়, শ্রম, ঘাম আর ঋণে জড়িয়ে আবাদ করা জমির ধান রক্ষা করতে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে শেষ দেখা হলো না বর্গা চাষি আবুল কালামের (৯০)। চর রমজান এলাকায় চাষ করা জমির ধান তুলতে গেলে স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ পান।

এ সংবাদ পেয়েও দস্যুদের হাত থেকে জমির ধান রক্ষা করতে গিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেননি। কিন্তু দস্যুদের হাত থেকে ধান রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ধান নিয়ে নদী পাড়ে আসা মাত্রই অস্ত্রের মুখে দস্যুরা তার প্রায় ২শ’ মণ ধান নিয়ে যায়।

চাষিরা জানান, যেসব জমির ধান লুট হয়েছে, সেসব জমির মালিকদের মধ্যে অধিকাংশই সাধারণ ভূমিহীন কিংবা মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক। এদের অনেকেই একমাত্র ওই জমির ধানের নির্ভরশীল। ধান লুট হওয়ায় এসব পরিবারগুলোকে সামনের মৌসুম ধারদেনা করে চলতে হবে। এর ওপর বিগত আবাদ মৌসুমে নেওয়া ধারকর্জ শোধ করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে।

চাষিদের অভিযোগ, দস্যুদের এ অপতৎপরতা শুধু ধানকাটা মৌসুমে নয়, আবাদ মৌসুম থেকেই শুরু হয় চাঁদাবাজি। জমি আবাদের সময় একর প্রতি এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা অবধি দস্যুদের দিতে হয়। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে কখনো কখনো জমি চাষের মেশিন ট্রাক্টর ছিনিয়ে নেওয়া হয়। কিংবা অন্য কোনোভাবে চাষিদের হয়রানি করা হয়।

সাবেক চেয়ারম্যান হানিফ মিয়া অভিযোগ করেন, প্রতি বছর আমন মৌসুমে কৃষকদের হয়রানি করছে জাসু বাহিনী। এবার ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে বাহিনীরা। প্রতি বছর আমন মৌসুমে কিছু চাঁদা নিয়ে চলে গেলেও এবার চাঁদা ও ধান দুটোই নিয়েছে তারা। এভাবে চলতে থাকলে চরাঞ্চলে চাষিরা আর ধান বা অন্য কোনো ফসল আবাদ করতে পারবে না। কৃষকদের বাঁচাতে দস্যুদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

চর ফকিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল বাংলানিউজকে বলেন, দস্যুদের দমনে আমাদের কিছুই করার নেই। কখনো নিজেরা প্রতিবাদ করি, কখনো প্রশাসনকে জানাই। দস্যুদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে সাধারণ চাষিরা দিনর পর দিন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।

কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান বলেন, ধান লুটের ঘটনা ও জাসু বাহিনীর অপতৎপরতা নিয়ন্ত্রণে যোগাযোগমন্ত্রীর নির্দেশে অচিরেই দুর্গম চরাঞ্চলে স্পেশাল পুলিশ ফোর্সের একটি ক্যাম্প স্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ওই ক্যাম্প সক্রিয় হলে দস্যু বাহিনীর তৎপরতা অনেকাংশে কমবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

বাংলাদেশ সময় ০২৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।