একসঙ্গে হাজারো দেশি ও অতিথি পাখির কলকাকলি, সরিষা ফুল পৌষের গোধূলির সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। অন্য যে কোনো অঞ্চল থেকে পুরোপুরি আলাদা রূপ এখানে।
এতেই মুগ্ধ হয়ে শ্রীমঙ্গল সফর সংক্ষিপ্ত করে হাকালুকি যাওয়ার সিদ্ধান্ত। রোববার পারাবত এক্সপ্রেসে কুলাউড়া। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা যোগে যখন হাকালুকির পুর্বতীর হাল্লায় (বড়লেখা অংশে) পৌঁছাই, তখন ঠিক গোধূলি। অর্থাৎ যে আশায় এখানে আসা সরাসরি তারই সাক্ষাৎ।
রাস্তা থেকেই দেখা যাচ্ছিল হলুদে ঢাকা বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেত। সূর্য তখন আলো ছড়ানো বন্ধ করে শুধু লাল আভা ছড়াচ্ছে। হাওরের পানিতে সে সূর্যের প্রতিবিম্ব মোহনীয় করে তুলেছে হাকালুকিকে। অনেকেই দলবেঁধে এসেছেন গোধূলি উপভোগে। বাহন যখন জিরো পয়েন্টে পৌঁছে গেলো, তখন সকলেই যেনো তার দায়-দায়িত্ব ভুলে গেলেন। গাড়িতে ব্যাগ রেখেই ছুট হাওরের দিকে। সহকর্মী নাসির উদ্দিনের ডাকে খানিকটা ছেদ পড়ে ব্যাগ নেওয়ার তাড়ায়।
গাড়ি থেকে লাগেজ নামিয়ে যখন হাকালুকির দিকে পা বাড়লো, তখন পাশ দিয়ে বিশাল বিশাল মহিষের পাল গ্রামের পথে ফিরছিল। আবার বাড়ি কাছাকাছি যাদের, এমন কিছু রাখাল তখনও মহিষের পালকে ঘাস খাওয়াতে ব্যস্ত। একেকটি পালে পনের থেকে পঁয়তাল্লিশটি পর্যন্ত মহিষ।
রাখালরা বেশিরভাগেই মাসোহারার ভিত্তিতে কাজ করেন। আবার কেউ কেউ রয়েছে এমন, যারা নিজেদের দু’ চারটি গরু মহিষ নিয়ে এসেছেন মাঠে চরানোর জন্য।
এখানে সরিষা ক্ষেতের পরে রয়েছে হাওরের খাস জমি। বর্ষা মৌসুমে পানি তলিয়ে থাকে। এখন দুর্বা ঘাসে ঠাসা। সেই দুর্বাগুলো মহিষের খাওয়ার পর দেখতে অনেকটা গলফ মাঠের মতো দেখাচ্ছে। যেনো কাঁচি দিয়ে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে।
অনেকে ডিঙি নৌকায় উঠে স্বচ্ছ জলে মাছ ও নানান জাতের পাখির খেলা দেখছেন। মাছগুলোও যেন খেলা দেখাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। নৌকার পাশ দিয়ে হঠাৎ করে লাফ দিয়ে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। আবার কোথাও টুপ করে শিকার ধরছে।
পুরো জলাশয়জুড়ে নানান জাতের পাখির মেলা। কোথাও সাদা বকে ঢাকা, দেখতে মনে হবে ঘন কাঁশফুলের বন। কোথাও পানকৌড়ির ঝাঁকের জলকেলি, কোথাও শামুক খোলের নীরব অবলোকন, মাঝে মাঝেই গাঙছিলের দুরন্তপনা। কোথাও আবার পরিযায়ী পাখির ঝাঁকের চলাফেরা। কোন দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবেন তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান দর্শনার্থীরা। কিন্তু গোধূলি লগ্ন তো আর কারও জন্য অপেক্ষা করবে না। এ বেলায়ও তাই হলো। চলতে চলতে মাঝির সঙ্গে ভাব জমে যায়। টুকটাক কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। তীরে তাঁবুতেই (পলিব্যাগের) থাকেন তারা তিনজন। রাত জেগে ফলুডাঙ্গা বিল পাহারা দেন, যেন কেউ মাছ চুরি করতে না পারে।
নৌকা থেকে নেমে তাঁবুর কাছে আসতেই চোখে পড়ে রাতের খাবারের আয়োজন। মাঝির সহযোগী জ্যান্ত দেশি সরপুটি মাছ কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। টিমের কয়েকজন দেখেই অবাক বনে যান। হায় হায় এই মাছ এখনও দেশে আছে। সেই শৈশবে দেখেছি! কী দারুণ স্বাদ!
মাছ নিয়ে এমন আলোচনা উঠতেই মাঝি অনুরোধ করেন রাতের খাবার খেয়ে যেতে। মাঝির সেই অনুরোধ উপেক্ষা করার ‘ধৃষ্টতা’ কেউ আর দেখাতে পারলো না! কয়েক মুহূর্তে কেটে ভাজা করে দিলেন দেশি সরপুটি। আর জানালেন তিনি অনেক ভালো রান্না করতে পারেন। অনেকেই খেয়ে তার তারিফ করেছেন। আগে-ভাগে জানিয়ে রাখলে যে কোনো মাছ তারা কিনে রান্না করে দেন। অনেকেই এখানে এসে টাটকা মাছের স্বাদ নিয়ে যান। অনেক বড় বড় মাছও পাওয়া যায় এখানে। দামও অনেক কম।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও বড়লেখা এবং সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জের ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টর জমি নিয়ে হাকালুকি হাওর। এরমধ্যে প্রায় ৯০টির মতো বিল রয়েছে। যার আয়তন চার হাজার চার’শ হেক্টর।
গবেষকদের মতে, এখানে দেড়’শ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ, শতাধিক জলজ উদ্ভিদ রয়েছে। শীতকালে বিপুলসংখ্যক বিরল প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে এই হাওরে।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৭
এসআই/এইচএ/