ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

পুরুষ সিঁদুরে-সাহেলির ভালোবাসা আত্মত্যাগেই

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭
পুরুষ সিঁদুরে-সাহেলির ভালোবাসা আত্মত্যাগেই টকটকে লাল রঙের পুরুষ সিঁদুরে-সাহেলি। ছবি: ইনাম আল হক

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): অধিকাংশ পুরুষ পাখিই বাড়তি বেশভূষার অধিকারী হয়ে আলাদা সৌন্দর্যে ভরপুর থাকে। অতিরিক্ত সাজসজ্জা এবং বাড়তি পালক থাকে শতকরা নিরানব্বই শতাংশ পুরুষ পাখির। স্ত্রী পাখিরা পুরুষ পাখির তুলনায় কম সুন্দরী হয়।

পাখি দম্পতির মাঝে পুরুষ সিঁদুরে-সাহেলির (Searlet Minivet) আত্মত্যাগ আমাদের একেবারেই অজানা, যা হৃদয়ে বেদনা তৈরি করে।

পুরুষ সিঁদুরে-সাহেলি পাখিটি একনজরেই চোখে পড়ার মতো।

সবুজ প্রকৃতির মাঝে সিঁদুর রঙের ঝলক তার, যা শিকারি পাখিদের দ্রুতই আকর্ষণ করে। শত্রুর তাড়া খেতে খেতে এক সময় সে খাদ্যে পরিণত হয়। তবে স্ত্রী-সন্তানদের বাঁচিয়ে রেখে যায়।  

পুরুষ পাখির  ভালোবাসার এমন আত্ম বলিদানই ‘স্কার্লেট মিনিভেট’ প্রজাতিকে যুগ যুগ ধরে পাখির রাজ্যে টিকিয়ে রেখেছে।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘পাখি দম্পতির মাঝে যে পাখিটা ডিমে তা দেবে, তার গায়ে বাড়তি সাজসজ্জা বা রঙচঙ নেই। অন্য পাখিটির তা রয়েছে। যে পাখির ক্ষেত্রে ছেলে পাখিটি ডিমে তা দেয়, মেয়ে পাখিটি দেয় না, সেক্ষেত্রে মেয়ে পাখিটির গায়ে সাজসজ্জা থাকে আর ছেলে পাখির থাকে না’। পাতার রঙে মিশে থাকা স্ত্রী সিঁদুরে-সাহেলি।  ছবি: ইনাম আল হক

‘কিন্তু ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরাই ডিমে তা দেয় কিংবা ছেলের সঙ্গে ভাগ করে দেয়। তা দেওয়ার বড় অংশটা মেয়েরা করে বলে তাদের শরীরটা এমন যে, তারা ডিমের ওপর বসে থাকার সময় আশেপাশের সব জিনিসের সঙ্গে তার দেহ মিশে যায়, যেন অন্যদের চোখে না পড়ে। কারণ, চোখে পড়লে তাকে অন্যরা খেয়ে ফেলবে’।

‘তাহলে ব্যাপার এমন দাঁড়ালো যে, যে পাখি ডিমে অধিকাংশ সময় বসে থাকবে  তার দেহের রঙ, যেখানে ডিম ও বাসা হবে তার চারপাশের মতোই হবে। মাটির হলে মাটির রঙ, ডাল হলে ডালের রঙ, পাতা হলে পাতার রঙ- এমনই হয়ে থাকে’- বলেন তিনি।    

ইনাম আল হক বলেন, ‘স্ত্রী পাখিটি ডিমে তা দেয় আর পুরুষ পাখিটি পাশেপাশে বসে পাহারা দেয়। হঠাৎ শত্রু এলে পুরুষটি চিৎকার দিয়ে সতর্ক করে, ডিমে তা দেওয়া স্ত্রী পাখিটি তাতে রক্ষা পায়। আরেকটি বড় বিষয় হলো, পাশে বসে থাকা পুরুষ পাখিটি শত্রুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকে সঙ্গে নিয়ে দূরে চলে যায়। পুরুষ পাখির দেহে রঙচঙ বেশি থাকায় শত্রুর দৃষ্টি তার দিকেই থাকবে। স্ত্রী, ডিম, বাচ্চা- এগুলো থেকে শত্রুকে সরিয়ে নিতেই পুরুষ পাখিরা বসে থাকে’। টকটকে লাল রঙের পুরুষ সিঁদুরে-সাহেলি।  ছবি: ইনাম আল হক

‘সিঁদুরে-সাহেলি প্রজাতির পুরুষ পাখির রঙ একদম সিঁদুরের মতো টকটকে। অথচ মেয়েটির একদম পাতার রঙ। মেয়েটিই ডিম দেয় এবং ডিমে তা দেয়। আর পুরুষ পাখিটি বাসার কাছাকাটি বসে থাকে। যদি ঈগল বা বাজ জাতীয় শিকারি পাখি তাদের ওপর হঠাৎ আক্রমণ চালায়, তবে ওই রঙচঙে পাখিকেই ধরবে’।

‘পুরুষ সিঁদুরে-সাহেলিটা তখন শত্রুর মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিতে পালাতে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেঁচে যায়, কিন্তু ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা মরে যায়। তবে ডিম ও বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রেখে যায়’।

‘এজন্যই শরীরে এদের এতো রঙচঙ। এ অতিরিক্ত সাজসজ্জার একটাই উদ্দেশ্য, ডিম ও ছানা থেকে শত্রুর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর ডিমে তা দেওয়া মেয়ে পাখিটির গায়ে সাদামাটা রঙ থাকার একটিই কারণ, শত্রুর চোখ এড়ানো’।

‘আমি নিজেও পুরুষ সিঁদুরে-সাহেলির এমন আত্মত্যাগ দেখেছি। বংশকে বাঁচিয়ে রাখতে তার এমন বলিদান সত্যি বিরল’- বলেন এই বরেণ্য পাখি গবেষক।      

বাংলাদেশ সময়: ১২৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭
বিবিবি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।