ময়লা আবর্জনার উৎকট দুর্গন্ধ আর সারাক্ষণ হকারের উৎপাত। এখানে বসা দায়, টেকা দায় সাধারণ মানুষের।
গুলিস্তান থেকে তাঁতিবাজার হয়ে বাবুবাজার ব্রিজে যেতে হাতের ডানে কিছু গাছ চোখে পড়ে। যার মৌখিক নাম জিন্দাবাহার পার্ক। আর পোশাকি নাম ‘সিরাজউদৌল্লা পার্ক। ’ পার্কটির আয়তন এক একরের একটু বেশি। প্রবেশপথের ডান পাশের গ্রিলে একটি ইঞ্চি দশেক লম্বা সাইনবোর্ডে ছোট করে লেখা ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা পার্ক, স্থাপিত-১৯৩৪। ’ তবে এটি ‘জিন্দাবাহার পার্ক’ নামেই এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত। ‘জিন্দাবাহার’ সম্ভবত ফার্সি শব্দ। বাংলায় যার অর্থ ‘তাজা বসন্ত’। কিন্তু পার্কের সার্বিক অবস্থা দেখে যে কেউ বসন্তের রূপ ভুলে যাবেন তা সহজেই অনুমেয়!
এখানে শুধু জিন্দাবাহার পার্ক এলাকাই নয়, পার্শ্ববর্তী অন্যান্য এলাকা যেমন কসাইটুলি, বাদামতলি, আশেক জমাদার লেন, আওলাদ হোসেন লেন, বংশাল, লালবাগ, নবাবপুর, নাজিমউদ্দিন রোড, ইংলিশ রোড, কুমারটুলি, পাটুয়াটুলি, চকবাজার এবং মাহুতটুলি সহ আরো বেশ কয়েকটি এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাগণ এই পার্কে আসেন একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে।
সরেজমিনে পার্কটি ঘুরে দেখা যায়, এক একরের এই ছোট্ট জায়গার পার্কটি চারদিক বিবর্ণ গ্রিল দিয়ে ঘেরা। মূল ফটকের সামনেই বাবুবাজার থেকে কেরানীগঞ্জ লেগুনা স্ট্যান্ড। পার্কের সামনের ফুটপাথে সার বেঁধে জাঁকিয়ে বসেছেন ফল বিক্রেতারা। ফলের প্যাকিং বাক্সগুলো রাখা হয়েছে পার্কের ভেতর। প্রবেশমুখের পুরু দেয়াল ঘেঁষেই ডাব বিক্রি করছেন কয়েকজন বিক্রেতা। নিয়মিত ডাব বিক্রি করে ডাবের খোসাগুলো স্তুপ করে রেখেছেন দেয়ালের ভেতরেই। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় এগুলোর পচা দুর্গন্ধ আশপাশের রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে। একই অবস্থা দক্ষিণের আলাওল হোসেন লেনের প্রাচীরটিতেও। সেখানে একেবারে সীমানা ঘেঁষেই বসানো হয়েছে ৩২ নং ওয়ার্ডের ডাস্টবিন, মাংসের দোকান ও কয়েকটি চায়ের ঝুপড়ি দোকান। দম বন্ধ হওয়া দুর্গন্ধের কারণে সেদিকটায় লোকজন খুব একটা যেতে চান না। আর পশ্চিমের অর্ধেক অংশ রয়েছে জিন্দাবাহার জামে মসজিদ এবং ছিন্নমূল দোকানের দখলে। সবমিলিয়ে একটি পার্কের যেসব সাধারণ উপকরণ থাকার কথা, সেখানে এর সিকি পরিমাণও নেই।
বিশেষ করে প্রাতঃভ্রমণকারীদের শারীরিক কসরতের জন্য নেই কোনো রাইডার বা সরঞ্জাম। চারদিকে হাঁটার পথটি পাকা হলেও এর কাঁচা মাঠের পুরো অংশেই রয়েছে মাটি। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই এর মাটি কাদা হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন দর্শনার্থীরা। কারণ পাকা যে রাস্তাটি রয়েছে, তাতে একসঙ্গে বেশি লোকের হাঁটা সম্ভব হয় না। আবার বসার স্থায়ী বেঞ্চও লোকসংখ্যার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
পার্কের সার্বিক অবস্থা বিষয়ে জানতে চাইলে পার্কে হাটতে আসা ‘ভোরের অতিথি’ সংঘের সভাপতি আনোয়ার হোসেন জানান ‘পার্কের এই অবস্থাকে জিন্দা না বলে মৃত বলাই শ্রেয়। পার্ক করা হয় যাতে অবসর মানুষ একটু প্রশান্ত চিত্তে একটু শ্বাস নিতে পারে। যেখানে পার্কের নূন্যতম সুবিধা নেই। সেখানে কিভাবে আমরা স্বস্তির শ্বাস নিই বলেন?
পার্কের তত্ত্বাবধায়ক আবু মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই ফুটপাতে দোকান বসে, তারা হয়তো ওয়ার্ড কমিশিনারের অনুমতি নিয়েই ব্যবসা করেন। এজন্য এ ব্যাপারে কেউ তাদের কিছু বলে না। ’
তিনি আরো জানালেন, পার্কের দরজা ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আগে সময় কাটানোর জন্য মানুষ এলেও এখন এখানকার বাসিন্দারা মূলত সকাল-সন্ধ্যায় হাঁটার জন্যই পার্কটি ব্যবহার করেন। ’
পার্কে হাঁটতে আসা বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল সেখানে শৌচাগারের অভাবের কথা। তাদের দাবি, সেখানে যেন দ্রুত আধুনিক টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়।
পার্কে নিয়মিত হাঁটতে আসেন ইংলিশ রোডের কুলসুম আক্তার। তিনি বলেন, ‘পার্কে এমনিতে কোনো অসুবিধা নাই। তয় একটা বাথরুম বানাইলে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুব সুবিধা হয়। ’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাতে এখানে প্রকাশ্যে মদ ও গাঁজার আসর বসে। বিশেষ করে রাত একটু বেশি হলেই এখানে গাঁজার গন্ধে টেকা দায়। ’
এদেরকে কে কেউ বাধা দেয় না কেন জানতে চাইলে পাশের এক দোকানদার বলেন, এদেরকে কে বাঁধা দিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবে?
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পার্কের তত্ত্বাবধায়ক আবু মিয়া বলেন, আমি তো রাত ৯টার পর চলে যাই। এরপর কি হয় তা তো বলতে পারি না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার বিল্লাল শাহ্ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে পার্কের এসব সমস্যা দূর করার জন্য সিটি কর্পোরেশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পাইনি। তবে আগামীতে এসব সমস্যা দূর করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা গ্রিন ঢাকা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এজন্য ধীরে ধীরে রাজধানীর ১৯টি পার্ক সংস্কারের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। এজন্য হাতে নেওয়া হয়েছে দুই বছর মেয়াদি প্রকল্প। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭ কোটি টাকা। প্রতিটি পার্ককে নতুন করে সাজাতে আনুমানিক ৪ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হয়েছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৭
ডিআর/জেএম