শুক্রবার (৩ নভেম্বর) ছুটির দিন থাকায় বাড়তি মজায় মেতে ওঠে চঞ্চল শিশু-কিশোরের দল। নানা ধরনের ছোট-বড় নৌকায় ভাসছে মানুষ।
‘পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না’
জয়সিদ্ধি গ্রামের শিক্ষক ফিরোজ আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, হাওরের শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা, বিনোদনসহ সকল কিছুই জল-নির্ভর। হাওরের অথৈ পানিই একমাত্র ক্ষেত্র। অতএব জলজ ক্রীড়া ও বিনোদনই তাদের অবলম্বন। জলে থাকা ছাড়া তাদের উপায় নেই। ভয় বা আতংক নয়, জলের সঙ্গে তাল মিলিয়েই তারা জীবন কাটায়।
‘শীতের অল্প কিছুদিন ছাড়া পুরো বছরই পানিতে টুইটুম্বুর থাকায় পানি ছাড়া অন্যত্র কিছু করার সুযোগ নেই শিশু-কিশোরদের’, বললেন ইটনার ব্যবসায়ী সরাফ খান, ‘যাতায়াত, যোগাযোগ তথা সমগ্র জীবন-যাপনই এখানে পানি ও নৌকা নির্ভর। ’
নৌকা ছাড়া বিশাল জলভাগে চলাচলের কোনো মাধ্যমই নেই হাওরে। সব বাড়িতেই আয় ও সামর্থ অনুযায়ী ছোট-বড় নৌকা দেখা গেল। দরিদ্ররা ব্যবহার করছে কলা গাছের ভেলা। গাড়ির যেমন ড্রাইভার আছে, গ্রামে তেমনি নৌকার জন্য মাঝি রাখা সম্ভব নয়। গ্রামের ছেলে-মেয়েরাই নিজ নিজ নৌকার মাঝি হয়ে কাজ সারছে। শিশু-কিশোররা আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নৌকা বাওয়ায়।
শুধু নৌকা চালনাই নয়, মাছ-ধরা, পরিবারের আনা-নেওয়া করা, বন্ধু-বান্ধবসহ স্কুলে যাওয়া, সবই তাদেরকে করতে হয় নদী পথে নৌকায়। সাঁতারেও এসব দুঃসাহসী শিশু-কিশোর ভীষণ পারদর্শী। প্রায়-সকলেই সাঁতরে ছোট-খাট হাওর পেরুতে পারে।
‘এমন ছেলেও আছে, গভীর হাওরে ডুব দিয়ে তলদেশের মাটি নিয়ে ভেসে ওঠে। দাঁতে শাপলা-শালুক নিয়ে কয়েক মাইল সাঁতার কেটে বাড়ির ঘাটে চলে আসে। ’ জানালেন চারিগ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ইউসুফ মিয়া। ‘এদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাঁতার শেখাতেও হয় না। পানিতে দাপাদাপি করেই একেকজন সাঁতারবিদ হয়ে ওঠে। ’ হাসতে হাসতে বললেন তিনি।
হাওরাঞ্চলের উপজেলাগুলোর কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, জেলা ও জাতীয় ভিত্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় হাওরের ছেলেমেয়েরা দারুণ ভালো করে। হাওরের নানা গ্রামে জাতীয় পদকপ্রাপ্ত অনেক ছেরেমেয়ে আছে। এমন একটি পরিবারের কথা জানা গেল। সেটি হলো, নিকলির কারার পরিবার। ওই পরিবারের কীর্তিমান সাঁতারু কারার মিজানের নাম হয়তো অনেকেরই জানা।
এমনই একজন দক্ষ সাঁতারু মিঠামইনের সন্তান আমাদের রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ। পূর্ব পাকিস্তান আমলে ব্যাক স্ট্রোক সাঁতারে জাতীয় পর্যায়ে রানার আপ হওয়ার খেতাব আছে তাঁর।
কর্মকর্তারা মনে করেন, জলনির্ভর খেলাধুলা, যেমন ওয়াটারপলো, নৌকাবাইচ, বিভিন্ন ধরনের সাঁতার ইত্যাদি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রশিক্ষণ ও সুবিধা দেওয়া হলে হাওরাঞ্চল থেকে অসংখ্য কৃতি খেলোয়াড় পাওয়া সম্ভব।
‘প্রাকৃতিক সুবিধা, যেমন প্রচুর পানি প্রবাহ ও জলক্ষেত্র থাকায় এখানে সহজেই ওয়াটার স্পোর্টস করার জাতীয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণাগার বা স্টেডিয়াম করাও সম্ভব। ’ বললেন উন্নয়ন সংগঠক সারাফ নাওয়ার। তার মতে, ‘শুধু মাছ বা ধান নয়, খেলাধুলা, বিনোদন ও পর্যটনের দিক থেকে অপার সম্ভাবনাময় বিস্তৃর্ণ হাওরাঞ্চলকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, সে ব্যাপারেও আমাদের নীতি-নির্ধারক ও পরিকল্পনাবিদদের মনোযোগী হতে হবে। ’
দিনব্যাপী হাওরের উথাল-পাতাল জলে ভেসে ভেসে মনে হলো, বাংলাদেশ আসলেই জলে প্রতিবিম্বিত একটি দেশ। বিশ্বব্যাপী যেখানে পানির সংকটের জন্য চলছে হাহাকার, সেখানে বাংলাদেশের জলসম্পদকে পুরোপুরি কাজে লাগানোই এখনো সম্ভব হয় নি। দিনের তেজ আর রাত্রির মায়াময়তায় হাওরের অপার সম্পদ ও সম্ভাবনা যেন সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
হাওরের শিশু-কিশোরদের জল ছলছল শৈশব সাহসী ও শক্তিশালী জলপুরুষ হয়ে বেড়ে ওঠার স্বপ্ন নিয়ে যেন অস্থির ডানা ঝাপটাচ্ছে!
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৭
এমপি/জেডএম