এরই মধ্যে দীর্ঘ পরিয়ান শেষে বাইক্কাবিলে এসে গেছে ‘ইউরেশীয়-সিঁথিহাঁস’। অন্য পরিযায়ী পাখির মতো এ হাঁসেরাও প্রতি বছরের মতো উড়ন্ত পথিক হয়ে চলে এসেছে।
সম্প্রতি বাইক্কাবিলের পাখি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠে দূরবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রেখে বিলের দিকে নিশানা নিক্ষেপে করতেই খুঁজে পাওয়া যায় ইউরেশীয়-সিঁথিহাঁস। দূরবীনে চোখ রেখে চলে আগত পর্যটকদের পাখিদের দেখার বিষয়টি বাড়তি ভালোলাগার জন্ম দেয়।
শীতের হাত থেকে রক্ষার জন্য উত্তরের হিমপ্রধান অঞ্চলগুলো থেকে অনেক প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী হয়। পাখিদের মধ্যে সাধারণত তিন ধরনের পরিযান দেখা যায়। এগুলো হলো- স্বল্পদৈর্ঘ্য পরিযান, মধ্যদৈর্ঘ্য পরিযান এবং দীর্ঘদৈর্ঘ্য পরিযান। সিঁথিহাঁস দীর্ঘদৈর্ঘ্য পরিযানের পাখি। এরা হাজার হাজার মাইল দূরত্বের পথ অনায়াসে উড়ে যেতে পারে। ক্লান্তিহীন ও বিশ্বস্ত পাখা তাদের এভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর ধরে।
পরিযায়ী সব হাঁসের মধ্যে একটি বিশেষ হাঁসকে চিনতে তেমন একটা অসুবিধা হয় না। কারণ হাঁসটির মাথা রাঙানো রয়েছে হালকা ইটহলুদ রং দিয়ে। সেই হাঁসটির নাম ইউরেশীয় সিঁথিহাঁস বা লালশির। এদের ইংরেজি নাম Eurasian Wigeon এবং বৈজ্ঞানিক নাম Mareca penelope। এরা মাঝারি আকৃতির হাঁসের মধ্যে বড় এবং মিঠাপানির জলাভূমির অস্থায়ী বাসিন্দা।
পাখি-পর্যবেক্ষক ও আলোকচিত্রী ওমর শাহাদাত বলেন, শীতে বাংলাদেশে পরিযায়ী হিসেবে যে প্রায় ত্রিশ প্রজাতির হাঁস আসে। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় দেখা যায় এই ইউরেশীয় সিঁথিহাঁস। এরা আমাদের দেশের সুলভ পরিযায়ী হাঁস। এরা বেশ দৃষ্টিনন্দন। পুরুষহাঁসের মাথায় হলুদ রঙের সিঁথি আছে বলেই এ নামকরণের কারণ। মিশ্র হাঁসের ঝাঁক থেকে সহজেই আলাদা করা যায় এদের। শীতকালে বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের উপকূলসহ নদী ও হাওরে দেখা যায়।
তিনি আর বলেন, ‘সিঁথিহাঁসের দৈর্ঘ্য ৫০ সেমি এবং ওজন ৬৭০ গ্রাম। এরা ধূসর নীলচে ঠোঁটওয়ালা মাঝারি আকারের হাঁস। পুরুষ ও মেয়ে হাঁসের চেহারায় পার্থক্য রয়েছে। প্রজননকালে পুরুষ হাঁসের স্পষ্ট হলুদ কপাল হয়। মাথা তামেটে, ডানার নিচের অংশ ধূসর ও লেজের নিচে কালো থাকে। লালচে বাদামি মেয়েহাঁসের ডানার নিচে পিতাভ। পেট সাদা ও ডানা খয়েরি। এরা সাধারণত অগভীর জলাশয় যেমন হ্রদ, নদী, হাওর, বিলে বিচরণ করে।
জলাশয়ের পাড়ে হেঁটে অথবা অগভীর জলে মাথা ডুবিয়ে খাবার খোঁজে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে ভেজা ঘাস, জলজ উদ্ভিদ, পোকা-মাকড়, লার্ভা ইত্যাদি। ইউরোপ হয়ে আফ্রিকার উত্তরাংশ ও এশিয়া পর্যন্ত এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি। এশিয়া মহাদেশে পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, চীন ও ফিলিপাইনে পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।
পরিযায়ীদের আগমন সম্পর্কে বন্যপ্রাণী গবেষক ওমর শাহাদাত বলেন, প্রতিবছর শীতে খাদ্য ও আবাসের জন্য হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এরা আমাদের জলাশয়গুলোতে আসে। এসে বরং উপকারই করে আমাদের। এদের বিষ্ঠা জমির উবর্বতা বাড়ায়। পানিতে সাঁতার কাটার ফলে মাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। পর্যটন শিল্পের প্রসারেও ভূমিকা রাখছে।
তবে সমাজের কিছু অসাধু, লোভী গুটিকয়েক লোকের কারণে এদের সংখ্যা দিন-দিন কমে যাচ্ছে। বিষটোপ, এয়ারগান প্রভৃতি দিয়ে নির্মমভাবে শিকার করা হচ্ছে তাদের। সারাবিশ্বে যেখানে পরিযায়ী পাখিদের সম্মান জানায় সেখানে আমরা এদের হত্যা করি। শিক্ষিত সমাজে রসনাবিলাসের জন্য সেগুলো কিনে কিনে শিকারিদের মৌন সমর্থন দেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৭
বিবিবি/এএ