শীতের এই দাপট শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেও হাঁড় কাপিয়ে দিচ্ছে এবার। শীতপ্রধান দেশেও এ বছর স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা পড়েছে।
বাংলাদেশে যেমন গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শীত পড়েছে এবার, আমেরিকায়ও তেমনি শত বছরের রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে বেশি শীত নামার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেখানে এরইমধ্যে তার লক্ষণ দেখা গেছে। আমেরিকায় যে তীব্র তুষার ঝড় বয়ে গেলো ক’দিন আগে, তারা এর নাম দিয়েছে ‘বোমা সাইক্লোন’। এই বোমা সাইক্লোনের জেরে এবার তাপমাত্রা নেমে যেতে পারে মাইনাস ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আমেরিকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু এলাকায় তীব্র শীতে এরইমধ্যে প্রায় ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। একদিকে রক্ত হিম করা তাপমাত্রা, তার ওপর তীব্র ও ভারি তুষারপাত ও শৈত্যঝড়-- সব মিলিয়ে বেঁচে থাকাই কঠিন। কিছু কিছু অঞ্চলে এমন বরফ পড়েছে যে, গত একশ’ বছরেও এরকম হয়নি বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
গরমের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। গত বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু বছরের রেকর্ড ভাঙা গরম পড়েছে। বৃষ্টির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশ গত বছর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়। পরিবেশের এই চরমভাবাপন্ন অবস্থায় অনেকেই ভাবছেন, কথিত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কি দৃশ্যমান হতে শুরুই করলো?
শৈশব থেকে জানা, বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত-- এই ছয় ঋতু নানা রূপ-বৈচিত্র্যে এখানে বিরাজ করে। কিন্তু এখন ষড়ঋতুর আর দেখা নেই। গ্রীষ্ম আর বর্ষা যেমন এক হয়ে গেছে, তেমনি শরৎ-হেমন্তও অনেকটা গ্রীষ্মের সঙ্গে মিশে গেছে। ফলে ঋতু হিসেবে এখন গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীতই দেখা যায়।
একসময় বলা হতো, বাংলাদেশ একটি নাতিশীতোষ্ণ দেশ। এখানে শীত বা গরম কোনোটিই বেশি করে অনুভূত হয় না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়া-জলবায়ুর এই বৈশিষ্ট্য আজ আর তেমন লক্ষ্য করা যায় না। ঋতুর আগমন ও ব্যাপ্তিকালেরও হয়েছে পরিবর্তন। পৌষ ও মাঘ-- দুই মাস শীতকাল, জানা কথা। কিন্তু এখন অগ্রহায়ণ আর পৌষ মাসেই যা শীত পড়ে। মাঘের শীতে বাঘকে কাঁপতে হয় না, পৌষের শীতেই বেহুঁশ! ঋতু আসা-যাওয়া আর সময়ের ব্যাপ্তি-সবকিছুতেই আজ ওলট-পালট।
আবহাওয়াবিদরা অবশ্য আগেই ধারণা করেছিলেন যে, অতিবৃষ্টির কারণে এবার শীত একটু বেশি পড়বে। কিন্তু সেই শীত যে এভাবে জেঁকে বসবে, তা বুঝি সবার কল্পনারও বাইরে ছিল।
বছরভেদে শীত, গ্রীষ্ম বা বৃষ্টির কম-বেশি হতেই পারে। এটি প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু এবার প্রায় পুরো বিশ্বজুড়েই শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষার যে বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা গেছে, সেটাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলতে নারাজ আবহাওয়াবিদরা। বিশেষজ্ঞরা একে প্রাকৃতিক পরিবেশের এক বিশৃঙ্খলা হিসেবেই দেখছেন। আর জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা আরও এক কাঠি এগিয়ে বলছেন, এটা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অতি সামান্যই বহিঃপ্রকাশ। তারা বলছেন, ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও বাড়বে বৈ কমবে না।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের হিসেব অনুযায়ী, আগামী একশ’ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে এবং বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা বাড়বে কমপক্ষে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জলবায়ুর বর্তমান তথ্য-উপাত্ত থেকে এই ধারণা করা হয়। কিন্তু যে মাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং মানুষ পরিবেশের ক্ষতি করছে, তাতে গড় তাপমাত্রা যে আরও অস্বাভাবিকভাবে বাড়বে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উষ্ণতা ‘অবশ্যম্ভাবী’।
কোথাও ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, আবার কোথাও প্রচণ্ড শীত, আবার কোথাওবা অস্বাভাবিকভাবে বরফ গলা-- এই যে জলবায়ু পরিবর্তনের উদ্বেগজনক পরিণতি, এর জন্য কিন্তু প্রধানত দায়ী শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোই। তাদের অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ-দূষণকারী কার্যক্রমের কারণেই জলবায়ু পরিবর্তনের হার ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ বা সাগর বুকের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভূমিকা কম হলেও এর ক্ষতির প্রভাব এখানেই বেশি। তাই এদেশের মতো উন্নয়নশীল, সমুদ্রোপকূলবর্তী, ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি রাষ্ট্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে জলবায়ু আন্দোলন জোরদার করতে হবে। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় সীমার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে যথাসাধ্য কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিতে হবে।
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কোনোটিই আমাদের হাতে নেই, আমাদের হাতে আছে পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সচেতনতা ও শুভ উদ্যোগ। আমরা তারই চর্চা করতে পারি-- ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৮
এইচএ/