মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী বিভাগের এসিএফ তবিবুর রহমান সম্পর্কে এমন মূল্যায়ন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বিট অফিসার আনোয়ার হোসেনের।
সম্প্রতি এসিএফ তবিবুর রহমানের বদলির আদেশ হয়েছে।
বিট অফিসার আনোয়ার হোসেন বলেন, আগের এসিএফরা দশ/পনেরো দিন পর একদিন বনে আসতেন। গাছ চুরির খবর দিয়েও নাগাল পাওয়া যেতো না। আর এমনও সময় গেছে উনি (তবিবুর রহমান) আমাদের সঙ্গে সারারাত ডিউটি করেছেন। দিনরাত একাকার করে বনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটেছেন। আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি তার মধ্যে ক্লান্তির ছাপ দেখিনি।
‘রাত তিনটায় ডিউটি করে বাসায় ফিরেছেন। ভোর ৫টায় গাছ চুরির খবর দিতেই আবার ছুটে এসেছেন। কাঠসহ ট্রাক আটক করে মামলা দিয়ে তবেই বাসায় ফিরে গেছেন’, এমন নজিরও রয়েছে।
আনোয়ার হোসেন বলেন, কাজ না করতে করতে, না করাটাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তিনি এসে সবাইকে সচল করে তুলেছেন। অনেক অফিসার দেখেছি দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালন করতেন। ভাবখানা এমন সরকারি সম্পত্তি থাকলেই কি আর গেলেই কি। কিন্তু তবিবুর রহমান নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করেন।
কথ বলতে বলতে গলা ভারি হয়ে আসে আনোয়ার হোসেনের। কপালে হাত ঠুঁকে বলেন, স্যালুট জানাই ওনাকে (এসিএফ)। দেশপ্রেম নতুন করে জাগ্রত করে দিয়েছেন। শুনেছি ওনার বদলি হয়েছে, যেখানে থাকেন আল্লাহ যেনো তাকে ভালো রাখেন। তার মতো সৎ ও সাহসী অফিসার বন বিভাগে আর নেই। এখানে প্রভাবশালীদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন। অন্য জায়গায় গেলে এতো কষ্ট পোহাতে হবে না স্যারকে। তবে তার মতো অফিসারের খুব দরকার ছিলো লাউয়াছড়া রক্ষার জন্য।
পরিবেশবাদী সংগঠক শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা সালাউদ্দিন জানান, তার (তবিবুর রহমান) বদলির খবরে লাউয়াছড়াপ্রেমীরা মুষড়ে পড়েছেন। আর মনে হয় লাউয়াছড়াকে রক্ষা করা গেলো না। এতোদিন তিনি না থাকলে লাউয়াছড়া বিপন্ন হয়ে পড়তো।
‘তবিবুর রহমান লাউয়াছড়াকে সমৃদ্ধ করেছেন, রক্ষা করেছেন। ৫০ একর জায়গা অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে বনকে বড় করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তিনি বনের সীমানা নির্ধারণের কাজ শেষ পর্যায়ে এনেছিলেন। সীমানা চূড়ান্ত হলে অনেক বড় কাজ হতো’।
আমরা এখন জানি না, লাউয়াছড়ায় আদৌ কতটুকু জায়গায় বনায়ন রয়েছে। এই কাজটি শুরু করেছিলেন এতে প্রভাবশালীরা তার উপর নাখোশ ছিলেন। তার এ বদলির পেছনে প্রভাবশালীদের হাত থাকতে পারে। মাত্র দু'বছরের মাথায় তাকে বদলি করার কী এমন কারণ, থাকতে পারে।
শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস আলী বাংলানিউজ জানান, তার এই বদলির কারণে লাউয়াছড়াকে অনেক মাশুল দিতে হবে। তার মতো প্রকৃতিপ্রেমী অফিসারের বড়ই প্রয়োজন ছিলো।
তার যোগদানের আগে লাউয়াছড়া অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য ছিলো। গাছ চুরি ছিলো নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা। শিকারীদের কারণে বিপন্ন হয়ে পড়েছিলো হরিণ, বন মোরগ, শুকর। এখন বনের সর্বত্র হরিণের বিচরণ চোখে পড়ে। বেপরোয়া পান চাষ চলে এসেছে নিয়ন্ত্রণে। রাজস্ব বেড়ে কোটির ঘর ছুঁয়েছে।
তবিবুর রহমানকে কাছ থেকে যারা দেখেছেন তাদের মূল্যায়ন এরকম।
স্বাধীনচেতা তবিবুর রহমান পুরোপুরি অন্যধাঁচের মানুষ। ভেবেচিন্তে যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেখান থেকে টলানোর সাধ্য কারো নেই।
লোভ-লালসা, প্রভাবশালীদের হুমকি তাকে সিদ্ধান্ত থেকে চুল পরিমাণ সরাতে পারেনি। যে কারণে সব সময় বিরাগভাজন হতে হয়েছে প্রভাবশালীদের। জীবনের হুমকি হজম করতে হয়েছে অনেকবার।
তবে পথে পথে সাধারণ জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। আনোয়ার হোসেনের মতো অনেকেই তার বিদায়ে নিরবে চোখের জল ফেলেছেন, হাত তুলে দোয়া করেছেন। আর দেখেছেন কিছু ভালো উদ্যোগের অপমৃত্যু। যেমন শংকা করছেন বাংলাদেশের ভিন্ন মাত্রার উদ্যান লাউয়াছড়াকে নিয়ে। তবিবুর রহমানের পরিণতি নতুন কর্তাকে সমঝোতার পথে ঠেলে দিতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৮
এসআই/জেডএস