ঢাকা: সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকারের মহোৎসব চলছে।
প্রজনন মৌসুমেও এ বনাঞ্চলের বিভিন্ন নদী ও খাল থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ মা-কাঁকড়া আহরণ করা হচ্ছে।
ফলে, বিদেশে রপ্তানিযোগ্য এ সম্পদ রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
একই সঙ্গে এ কাঁকড়া সম্পদ রক্ষায় বিভিন্ন মহল থেকে অভয়াশ্রম ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের জোরালো দাবি তোলা হয়েছে।
জানা গেছে, বর্তমানে মংলায় ডিমওয়ালা ১ হাজার ৪শ থেকে ১ হাজার ৮শ টাকা কেজি দরে মা-কাঁকড়া বিক্রি হচ্ছে।
সরেজমিন ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের অন্যতম মৎস্য সম্পদ কাঁকড়ার প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র হলো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। আর বিশ্বের প্রধানতম ম্যানগ্রোভ এলাকা হলো সুন্দরবনসহ দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকা। এখান থেকে আহরিত কাঁকড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে।
দেশের দুই-তৃতীয়াংশ চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় কাঁকড়া রপ্তানি করে। এ পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানিতে বসবাসকারী ১২ প্রজাতির কাঁকড়া শনাক্ত করেছেন মৎস্য গবেষকরা। এর মধ্যে স্কাইলা সিরাটা, অলিভিসিয়া, প্যারামসিন, ট্রাঙ্কুবুরকিয়া। এ ৪ প্রজাতির কাঁকড়া বাংলাদেশে সর্বাধিক পাওয়া যায় বলে জানা গেছে।
এসব কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি ২ মাস। প্রজনন মৌসুমে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের নোনা পানিতে এরা ডিম ছাড়ে। আর মাঘ মাসের প্রথম অমাবস্যায় সবচেয়ে বেশি ডিম দিয়ে থাকে স্ত্রী-কাঁকড়া।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রতিটি পূর্ণ বয়সের স্ত্রী-কাঁকড়া প্রতিবছর পরিবেশের ওপর নির্ভর করে ৮০ হাজার থেকে ১০ লাখ ডিম দেয়। অভয়াশ্রম না থাকায় ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জীববৈচিত্র্যের পরিবেশ বিপন্ন হওয়ায় ১০ শতাংশ ডিম পূর্ণাঙ্গ গ্রেডে পরিণত হয়। ডিম থেকে পিল (রেণু) কাঁকড়া ১শ ৮০ গ্রাম ওজনের পূর্ণ গ্রেডে (এফ-১) পৌঁছাতে ২ থেকে ৩ মাস সময় লাগে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের মতো কাঁকড়ারও এ প্রজননকালীন সময় পরিবর্তন হয়েছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এই ২ মাস জুড়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংকং, চীনসহ বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আর এসব উৎসবের খাদ্য তালিকায় ডিমওয়ালা কাঁকড়ার চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও ডিমওয়ালা কাঁকড়ার চাহিদা সবচেয়ে বেশি এবং এ সময় দামও থাকে সর্বোচ্চ। তাই, বেশি দামের আশায় এবং সুন্দরবন ছাড়া অন্য ম্যানগ্রোভ এলাকায় প্রজননকালীন কাঁকড়া শিকার বন্ধের সরকারি উদ্যোগ না থাকার ফলে ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকারে চলে মহোৎসব। প্রজননকালীন কাঁকড়া শিকার, কারেন্ট, বেহুন্দিসহ ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ শিকার করার সময় পিল (রেণু) কাঁকড়া ধরা পড়ায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবসহ নানা কারণে উপকূলের জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক পরিবেশও ব্যাহত হচ্ছে। এসব কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে অতি মূল্যবান সম্পদ কাঁকড়া।
সে কারণে প্রজননকালীন কাঁকড়া শিকার বন্ধ ও অভয়াশ্রম গড়ে তোলার দাবি সংশ্লিষ্টদের। চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়ার চাষ সহজ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য ও চাহিদাও বেশি। চিংড়ির চাষে নানা ধরনের রোগ-বালাই লেগেই থাকে।
অপরদিকে, কাঁকড়ার তেমন রোগ-বালাই নেই বললেই চলে। এছাড়া চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়া চাষে ব্যয়ও কম। প্রাকৃতিকভাবে পিল কাঁকড়া ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে ১শ ৮০ গ্রাম ওজনের গ্রেড হয়।
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে প্রতিদিন শত শত শিকারি ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকার করছেন।
এলাকার এক কাঁকড়া শিকারি বাংলানিউজকে জানান, প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ কেজি কাঁকড়া পান তিনি। ২ থেকে ৩টি কাঁকড়ায় ১ কেজি হয় এবং প্রতিকেজি কাঁকড়া ১ হাজার ৪শ থেকে ১ হাজার ৮শ টাকায় বিক্রি করেন। এখন কাঁকড়া বেশি ধরা পড়ছে এবং দামের দিক দিয়েও ভালো বলেও জানান তিনি।
সুন্দরবনে কাঁকড়া আহরণকারী জেলে তালেব, স্বপন মণ্ডল ও মহসীন আলম জানান, বর্তমানে সরকারিভাবে কাঁকড়া শিকার নিষিদ্ধ থাকার কারণে তারা ‘মাছের পাস’ নিয়ে বনে ঢুকে কাঁকড়া শিকার করছেন। এছাড়া তারা এক সপ্তাহের জন্য অনুমতি নিয়ে বনে যাওয়ার পর অতিরিক্ত কয়েক দিন কাঁকড়া ধরার কারণে নির্ধারিত হারে জরিমানা পরিশোধ করে ফিরে আসছেন বলেও স্বীকার করেন।
এদিকে, স্থানীয় কাঁকড়ার আড়তদাররা জানান, এখন ডিমওয়ালা কাঁকড়া পাওয়া যায় বলে ঢাকার আড়তে এসব কাঁকড়ার বেশ চাহিদা রয়েছে এবং দামের দিক দিয়েও ভালো। অন্যসময় ডিমওয়ালা কাঁকড়া পাওয়া যায় না বলে তেমন চাহিদা থাকে না। এখানকার অর্ধশতাধিক আড়তদার প্রতিদিন কয়েকশ মণ ডিমওয়ালা কাঁকড়া ঢাকায় পাঠান বলেও জানান।
সুন্দরবনের মধ্যে বিভিন্ন খালে কাঁকড়া শিকার করা হলেও উদ্বেগজনক হারে শিকার করা হচ্ছে চাঁদপাই স্টেশনের আওতাধীন অফিসগুলোর এলাকা থেকে। এ জন্য নেওয়া হয়, মোটা অংকের উৎকোচ।
এ ব্যাপারে মংলা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এজেডএম তৌহিদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ অঞ্চল কাঁকড়ার প্রজননক্ষেত্র হলেও শুধু সুন্দরবন এলাকায় প্রজননকালীন শিকার নিষিদ্ধে আইন রয়েছে। এ ছাড়া কাঁকড়া শিকার বন্ধে তেমন কোনো নির্দেশনা না থাকায় মৎস্য বিভাগ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। ’
এদিকে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো জানান, প্রজনন মৌসুমকে ঘিরে সুন্দরবনে কাঁকড়া আহরণের পাস-পারমিট বন্ধ রয়েছে। তবে চোরাই পথে কাঁকড়া আহরণের প্রবণতা বন্ধে বন বিভাগের টহল ও নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘চলতি মাসে (ফেব্রুয়ারি) নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সুন্দরবন থেকে অবৈধভাবে কাঁকড়া শিকারের দায়ে ৮ জেলেকে আটক ও আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। ’
তবে বন বিভাগের দাবি, শুধুমাত্র সুন্দরবনের নদনদীতে প্রজনন মৌসুমে কাঁকড়া আহরণ নিষিদ্ধ থাকলেও লোকালয়ের জলাভূমিতে এ আইন কার্যকর না থাকায় তেমন কোনো সফলতা আসছে না।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও কাঁকড়া বিশেষজ্ঞ ড. খন্দকার আনিসুল হক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়ার দাম ও চাহিদা বেশি। এ কারণে প্রজনন মৌসুম ও পরবর্তী সময়ে কাঁকড়ার শিকার বন্ধ এবং এ মূল্যবান মৎস্য সম্পদ রক্ষায় অভয়াশ্রম ও আইনি পদক্ষেপসহ গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১২