ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

‘প্রাণবিক সাইমুনের গল্প’

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৪ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০২২
‘প্রাণবিক সাইমুনের গল্প’

ফেনী: পৃথিবী টিকে আছে ভালোবাসায়, ভালোবাসার বিশালতা কল্পনাকেও হার মানায়। আমাদের মাঝেই আছেন এমন কিছু মানুষ যারা ভালোবাসা ছড়িয়ে দেন শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতির সব প্রাণে।

তাদের সেই ভালোবাসা, আর যত্নে ভালোভাবে বেঁচে থাকে অসহায়, অবহেলিত অনেক পশু-পাখিও। তেমনই একজন প্রাণবিক মানুষ ফেনীর সাইমুন ফারাবী।

পেশায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানার এই তরুণ নিজের পেশাগত কাজের বাইরে বাকি পুরো সময় ব্যয় করেন প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসায়। জেলার যেখানেই কোনো অসহায় প্রাণীর খবর মেলে সেখানেই ছুটে যান এই তরুণ। নিজের উপার্জিত কষ্টের টাকা খরচ করে পরম আদর আর যত্নে বিপদগ্রস্ত প্রাণীকে উদ্ধার করে চিকিৎসা আর সেবা দিয়ে করে তোলেন সুস্থ। শুধু সেবা, চিকিৎসা করেই ক্ষান্ত হননি ওই তরুণ।  প্রাণীদের প্রতি সমাজের অন্যদের মধ্যে ভালোবাসা বাড়ানোর জন্যও কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৈরি করেছেন 'ফেনী এনিম্যাল লাভার্স'  নামের একটি গ্রুপ। এখন গ্রুপটির সদস্য সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০ হাজার। গ্রুপের সক্রিয় সদস্যদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘ফেনী এনিমেল লাভার্স ওয়াইল্ডলাইফ রেস্কিউয়ার টিম’।

সাইমুন বলেন, আমরা মানুষরা যেমন এই পৃথিবীর সন্তান। ঠিক তেমনি অন্য প্রাণীও সমানভাবে এই পৃথিবীর সন্তান। মানুষের যতটুকু অধিকার রয়েছে এই পৃথিবীর প্রতি, একটু অবাক শোনালেও ঠিক ততোটাই অধিকার রয়েছে প্রতিটি প্রাণীর। আমরা মানুষরা জ্ঞান-বুদ্ধি, প্রযুক্তি দিয়ে পৃথিবীকে জয় করেছি বলেই এই পৃথিবীর একমাত্র দাবিদার মানুষ হয়ে যাইনি। প্রাণীদের প্রতি সদয় হওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এমন বোধ থেকেই এ ধরনের কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছি। প্রথমে প্রাণীদের উদ্ধার করার জন্য একা গেলেও এখন অনেক তরুণ-তরুণী এ কাজে সাড়া দিচ্ছেন। উদ্ধার টিমের সদস্য সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে টিমে সদস্য সংখ্যা ১৫ জন, এর মধ্যে রয়েছে ৪ জন মেয়ে সদস্য। সাইমুন আরও বলেন, করোনাকালীন যখন দেশে সর্বাত্মক লকডাউন চলছিল। হোটেল, রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ ছিল। মানুষের চলাচল ছিল সীমিত। তখন খাদ্যের অভাবে রাস্তার কুকুর, বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণীরা না খেয়ে মারা যাচ্ছিল। সেই সময়টায় প্রাণীদের পাশে ছিলেন তিনি ও তার টিম। অভুক্ত প্রাণীদের মুখে তুলে দিয়েছিলেন খাবার।

সাইমুন জানান, এ পর্যন্ত ৮ প্রাণীকে উদ্ধার করেছে তিনি ও তার টিমের সদস্যরা। এর মধ্যে রয়েছে একটি রেসাস বানের বাচ্চা, একটি বাদামী বানর, দুটি বাজপাখি ঈগল, একটি হুতুম পেঁচার ছানা, মাসহ চারটি গন্ধগোকুল।

প্রাণী, উদ্ধার, সেবা এবং অবমুক্ত করা এ কাজটি ব্যয়বহুল হলেও কারো কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা না নিয়ে নিজের পকেট থেকেই খরচ করছেন সাইমুন।  

প্রাণীদের ওই বন্ধু বলেন, মানুষ রাস্তার কুকুর-বিড়াল দেখলে মারতে চায়, তাড়িয়ে দেয়, গরম পানি মারতে চায়, তাদের জন্য কেউ কিছু করে না, বর্তমানে আমাদের দেখাদেখি মানুষ অনেকটা সচেতন হতে পেরেছে। মানুষের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীদের ও মায়া-মমতা করলে তারাও সুন্দর থাকে।

এমন কাজের উদ্দেশ্যের বাপারে জানতে চাইলে সাইমুন বলেন, মানুষ প্রকৃতির সন্তান, আবার মানুষ প্রকৃতিকে ছাপিয়েও উঠেছে। চেতনা পেয়েছে বলেই আমরা নেহাত জীব হয়ে থাকিনি। আমরা মানুষ হয়ে উঠেছি। স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন অর্জনের জন্য জীবন বাজি রাখি, অন্যকে ভালোবেসে নিজেকে বিলিয়ে দিই, ভবিষ্যতের মানুষের জন্য নিজেকে সংযত রাখি। আমাদের দায় আছে, মানুষ হিসেবে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি আমাদের এ দায় জন্মগত। আমরা সেটি ভুলে যেতে পারি না। আমরা প্রকৃতিকে ছাপিয়ে উঠেছি, কিন্তু প্রকৃতিকে পার হয়ে যাইনি। সেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার দায় আমাদের। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার একটাই উপায়, আমাদের রাক্ষুসে খিদে কমিয়ে পৃথিবীকে সবুজ করে রাখা। সবুজ মানে গাছ, প্রাণী আর মানুষের একাকার পৃথিবী।

ওই প্রাণীপ্রেমী বলেন, সমাজে অনেক মানবিক স্বেচ্ছাসেবী থাকলেও অবলা অসহায় প্রাণীদের জন্য কেউ কাজ করার প্রাণবিক মানুষ খুব একটা চোখে পড়ে না। হুট করে একটা গ্রুপ খুলে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে অনলাইনভিত্তিক কাজ শুরু করি আমরা।  বর্তমানে ফেনীতে আমাদের টিমের কার্যক্রম অব্যাহত আছে এবং আমাদের পরিকল্পনা আছে বড় পরিসরে একটি প্রাণীপ্রেমী সংগঠন করার। ভবিষ্যতে ব্যাপ্তি ঘটবে এ সংগঠনের, সংগঠনের প্রতিটি সদস্য হয়ে উঠবেন প্রাণবিক।

প্রাণবিক ওই তরুণ বলেন, বন্যপ্রাণী অধিদপ্তরের পরিচালক জহির আকন, পরিদর্শক অসিম মল্লিক/বায়েজীদ বোস্তামি সাজিদের মাধ্যমে বনবিভাগ ফেনীর মাধ্যমে অনেক সময় তারা কাজ করেন। অনেক সময় বন বিভাগও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে প্রাণীদের রেস্কিউ করার জন্য।

এই কাজে সাইমুনকে তার গ্রুপ ফেনী এনিমেল লাভারর্স গ্রুপের বিভিন্ন সদস্যরাও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে। অসুস্থ প্রাণী হলে ভেট (পশু চিকিৎসক) মোহাম্মদ ইব্রাহীম আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে থাকেন। পাশাপাশি টিমের প্রত্যেক সদস্যরাও নিজেদের মতো করে সহযোগিতা করেন।
 
সম্প্রতি এ গ্রুপের সদস্যদের নিয়ে শহরের একটি মিলনায়তনে মিলনমেলার আয়োজন করা হয়। দিনব্যাপী এ আয়োজনে এতে অংশ নেন জেলার প্রাণীপ্রেমীদের অনেকেই।

সাইমুনের কার্যক্রম নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের জুনিয়র স্কাউটি বায়োজিদ বোস্তামী সাজিদের সঙ্গে।

তিনি বলেন, সাইমুন ফারাবী যে কাজটি করছেন তা খুবই প্রশংসার দাবি রাখে। বন বিভাগের লোকবল স্বল্পতা রয়েছে। সারা দেশে সাইমুনের মতো যদি অন্য তরুণরাও এগিয়ে আসেন তাহলে বন্যপ্রাণী অধিদপ্তরের কাজটাও সহজ হয়ে যায়।

এ বিষয়ে কথা হয় প্রাণিচিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রায় সময় সাইমুন ও তার টিম অসুস্থ ও বিপদগ্রস্ত প্রাণীদের উদ্ধার করে আমার কাছে নিয়ে আসে। আমি একদম বিনামূল্যে ওষুধ এবং চিকিৎসা দিয়ে থাকি। সাইমুনরা যে কাজটি করছেন এটি তারা শুধু করলে হবে না সমাজের আরও মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রাণীদের সেবা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ফেনীতে সাইমুনরা শুরু করেছেন আশা রাখবো আরও অনেকে এ কাজে এগিয়ে আসবেন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০২২
এসএইচডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।