ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ আষাঢ় ১৪৩২, ১৭ জুন ২০২৫, ২০ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

তরুণ প্রজন্মের রাজনীতি ভাবনা

স্বপ্নযাত্রা ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:২২, এপ্রিল ২৪, ২০১২
তরুণ প্রজন্মের রাজনীতি ভাবনা

বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত। সম্প্রতি বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম হওয়াকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নানা নাটকীয়তা।

বিএনপি রাজনীতির মাঠ চাঙ্গা করতে টানা হরতাল করে যাচ্ছে। হরতালকে ঘিরে তৈরি হয়েছে জনমনে অশান্তি অস্থিরতা। অন্যদিকে সরকারও বিরোধীদলের উপর চড়াও হচ্ছেন।

শুধুমাত্র গুম হওয়া নয়। রাজনীতির ফাঁদে পড়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোও বিপাকে পড়েছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির তদন্তের অগ্রগতি নিয়েও সবাই হতাশ। এছাড়া ছিনতাই, ডাকাতি, খুন সহ বিভিন্ন অপরাধের আঘাতে আছে গোটা জাতি।

এসব বিষয় নিয়ে; বিশেষ করে বর্তমান উত্তপ্ত রাজনীতি নিয়ে তরুণরা কী ভাবছেন? এমন প্রশ্নই করা হয়েছিল স্বপ্নযাত্রার পক্ষ থেকে। তারা প্রত্যেকেই বলেছেন রাজনীতি নিয়ে ভাবনার কথা।

এবারের স্বপ্নযাত্রার আয়োজনে থাকছে রাজনীতি প্রসঙ্গে আমাদের তরুণ প্রজন্মের ভাবনা।    

সালেক খোকন, আদিবাসী বিষয়ক গবেষক

Salek_Khokonদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে, এসেছে সচেতনতা। কিন্ত রাজনীতিবিদরা আগের জায়গাতেই রয়ে গেছেন। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো ছাত্র যুক্ত ছিল ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে। রাজনীতিতে তখন ছিল দেশপ্রেম, সততা, সহমর্মিতা আর স্বার্থত্যাগের চর্চা। এখন তো বদলে গেছে অনেক কিছু। অবৈধ টাকার দাপট, শক্তিপ্রদর্শন এবং ব্যক্তিস্বার্থের চিন্তা যার মধ্যে যত প্রবল সে রাজনীতিতে তত শক্তিশালী। ফলে দেখা যাচ্ছে আমাদের মত তরুণরা রাজনীতিতে তেমন আগ্রহী না।

অন্যদিকে এখন চলছে রাজনীতি রাজনীতি খেলা। সাধারণ মানুষ ‘গুম’ হলে কেউ হরতাল করে না। কিন্তু যখন কোনো দলের নেতা গুম হচ্ছেন তখন ঠিকই তারা সোচ্চার হচ্ছেন। বিরোধীদল তাদের সাংগঠনিক সম্পাদককে জীবিত চাচ্ছেন। এই চাওয়ার আন্দোলনে যেসব নিরপরাধ মানুষ মৃত্যবরণ করছেন তাদের কি তারা জীবিত ফেরত দিতে পারবে? সরকারি দলের নেতাদের লাগামহীন কথা উস্কে দিচ্ছে বিরোধীদলের আন্দোলনকে। আমি মনে করি, তদন্ত কিংবা অভিযানের আগেই দেশের কর্ণধারদের উক্তি বাধাগ্রস্থ করছে তদন্তকে। ফলে মানুষের মনে জন্ম নিচ্ছে নানা প্রশ্ন। একজন মানুষকে গুম কিংবা হত্যা করা হোক না কেন; তা দ্রুত উদ্ধারের দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই।

রাজনীতি ছাড়া দেশের পরিবর্তন সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধেও রাজনীতিবিদরাই মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। রাজনীতিতে এখনও অনেক ভালো মানুষ আছেন। দেশপ্রেম, দেশ ও মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট খুবই জরুরী। স্বার্থচিন্তা থেকে বেরুতে না পারলে এদেশে রাজনীতিবিদদের গুনগত পরিবর্তন আসবে কিনা সন্দেহ আছে।

রুম্পা ফারজানা জামান, লেখক ও বিজ্ঞাপনকর্মী

Rumpaউত্তপ্ত রাজনীতি শব্দটি বা এই ধারণাটিই সমাজের জন্য, দেশের জন্য সর্বোপরী তরুণদের জন্য শঙ্কার এবং হতাশাজনক। আমাদের সমাজের অবস্থা এখন এরকম যে তরুণ সমাজ একটি শিশুর মতো চিৎকার করে  কেঁদে যাচ্ছে কিন্তু কেউ তাকে কোলে তুলে নিচ্ছে না। এর ফলাফল কি হতে পারে? এর ফলাফল হতে পারে একটাই, নব্বইয়ের মতো দেশ ছেড়ে চলে যাবে তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ। ফলে দেশ পিছিয়ে যাবে আরো দশ বছর। কেউ কেউ বলতে পারেন, তরুণরা না গিয়ে লড়াই করলেই পারে।

সত্যি কথাটি হলো- তরুণরা চেয়েছিল, এই সরকারের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে তারা বদলে দেবে বাংলাদেশ। কিন্তু তার বদলে হয়েছে কী? নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান দাম, বেঁচে থাকার জন্য সাধারণ মানুষের চেষ্টা, গ্যাস-বিদ্যু‍ৎয়ের ঘাটতি তার উপর মাসে মাসে বাড়তি মূল্য-  এগুলো উত্তপ্ত করছে মানুষকে।

আমাদের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব না সাগর-রুনির কথা। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির নিজঘরে রহস্যজনক ভাবে খুন হয়ে যাওয়া। এমন অনেক ঘটনাই চোখের সামনে ঘটে গেছে যা তরুণদের মন ভাঙার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। আজকে অনেকেই বলতে পারেন, কোন এক ব্যক্তির জন্য রাজনীতি উত্তপ্ত, দেশ অস্থির, কিন্তু আমার মনে হয় এই অস্থিরতা আসলে অনেকদিনের জমাটবাধা ক্ষোভের বহি:প্রকাশ।

আমরা তরুণরা দেশের জন্য কাজ করতে প্রস্তুত সব সময়। আজকে তরুণ তুর্কিরা বিদেশে গিয়ে সুনাম অর্জন করছে, কিন্তু সে কি এই দেশে নিরাপদ? তার কি মনে ভয় নেই যে আজকে তার সন্তান এই দেশে জন্ম নিলে মাত্র কিছু টাকার জন্য তাকে অপহরণ করা হতে পারে? এই ভয় থাকলে আমরা অস্থির হবো না?

রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যদি শুধু নিজেদের দলের ভালোমন্দ বিচার না করে দেশের সবার জন্য চিন্তা করে পদক্ষেপ নেন, তাহলে এই দেশে কোন অস্থিরতা থাকবে না, কোন উত্তপ্ত পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অফিস বা পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে হবে না। আমি আশা করি ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে হলেও রাজনীতিবিদরা দেশের কথা ভাববেন।  

হাফিজুন্নাহার বুবলী, শিক্ষার্থী, সেন্ট্রাল ল কলেজ

bubleএক সময় এদেশে কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে উঠতো না। এখন দেখবেন, মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করে। তার মানে আইন মানার মানসিকতা সাধারণ মানুষের মধ্যে আছে। এদেশে আইন আছে, তৈরিও হচ্ছে। কিন্ত ব্যবহার হচ্ছে স্বার্থভেদে।

রাজনীতিতে এখন ‘গুম’ আগুনে উত্তপ্ত প্রসঙ্গ। এদেশে মানুষ গুম হচ্ছে অনেকদিন ধরে। কিন্ত হরতাল হলো যখন একজন নামকরা রাজনীতিবিদ গুম হলন। যে কোন মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আমি মনে করি, জনগণকে নিরপত্তাহীনতায় রেখে কর্তাব্যক্তিদের বেসামাল কথা বলা ঠিক নয়। আবার নিরপত্তাহীনতার প্রতিবাদ জানাতে সারাদেশের সাধারণ মানুষকে জিম্মি করাও নীতিসিদ্ধ নয়। এছাড়া চলমান হরতালে যে মানুষটি আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেল তাদের পরিবারের কাছে কি জবাব দেবে রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতিবিদরা?

এদেশে রাজনীতিবিদরা মুখে যা বলে তা করে না। যা করে তা বলে না। দেশপ্রেমের কথা বলে মুখে ফেনা তোলে কিন্ত দেশের সম্পদ বিক্রি করতেও দিধা করে না। রাজনীতিবিদদের মধ্যে সততা, দেশপ্রেম আর দায়িত্ববোধ তৈরি না হলে দেশের অবস্থারও তেমন পরিবর্তন হবে বলে মনে হয়।

একরামুল হক শামীম, সাংবাদিক ও ব্লগার

Akramul-Huqউত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের জন্য কোনভাবেই কল্যাণ বয়ে আনে না। সরকারি ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির যাতাকলে ভুগছে সাধারণ মানুষ। গত কয়েকদিন ধরে হরতাল চলছে। আর প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এভাবে আর কতো চলবে? জনগণের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতা কী কেবল নির্বাচনের সময়ই থাকবে? আর অন্য সময়গুলোতে জনগণকে দূর্ভোগ দেবে দলগুলো? এই রাজনৈতিক রেষারেষির অবসান হওয়া জরুরি। রাজনীতিতে এতো নোংরা করা ফেলা হয়েছে যে এখনকার শিক্ষিত তরুণেরা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে কোন গণতান্ত্রিক দেশের জন্য কাম্য হতে পারে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী মিলে পদক্ষেপ নিলেই রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে যায়। অথচ তারা ব্যস্ত নিজেদের ইগো নিয়ে। ইগোর লড়াইয়ে পুড়ে পড়ছে দেশের জনগণ!

হাসিবুল হক, আর্কিটেক্ট, মডিউলার ডিজাইন স্টুডিও

Hasibআমাদের রাজনীতি সংস্কৃতির পুরো প্যাকেজটাই এখন হয়ে গেছে ‘মাঠ দখলের পাঁয়তারা’। সাম্প্রতিক যে ভয়াবহ অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে রাজনীতিতে, তার পেছনেও সেই দখলের চিন্তা ছাড়া আর কিছু নেই।

বাইরের দেশগুলোতে দেখা যায় মন্ত্রিত্ব বা বড় কোন দায়িত্ব পাওয়াকে নেতারা মনে করেন কর্তব্য পালনের সুযোগ। দায়িত্ব পালনে শতভাগ নিয়োজিত থাকার একটা ন্যুনতম প্রচেষ্টা দেখা যায় তাদের মাঝে, সেখানে বাংলাদেশে আমি অনেকবার দেখেছি কেউ মন্ত্রিত্ব পেলে খুশি হয়ে বলেন ‘উপহার পেলাম’। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট – ‘উপার্জন করে দেখিয়ে দেব মন্ত্রিত্ব কাকে বলে’।

একটা জিনিস বহুদিন ধরেই লক্ষ্য করছি, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বড় একটা অংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তাদের অনেকের ফেসবুক প্রোফাইলের পলিটিক্যাল ভিউজে লেখা থাকে – ‘হেইট পলিটিক্স’। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের নোংরামি এমন পর্যায়ে গেছে যে, যাদের থেকে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব আসার কথা, তারা এখন ব্যাপকভাবে রাজনীতিবিমুখ। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিতৃষ্ণা এখন আমাদেরকে নেতা তৈরি করার পথচলাতেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় নানারকম সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু তবু যারা এই ইস্যুর অস্থিরতায় প্রাণ দিল, তাদের কথা কেউ বলছে না। যে জনগণের জন্য রাজনীতি, তাদেরকেই মরতে হচ্ছে। একজনকে নিয়ে ইস্যু তৈরি করে সেই ইস্যুতে সাধারণ জনগণের লাশ ফেলে দেওয়া, তারপর সেই লাশ নিয়ে আবারও ইস্যু তৈরি করা –এগুলো দেখলে সত্যিই কষ্ট হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক, স্বপ্নযাত্রা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।