মৌলভীবাজার: এক সময় ব্যাপক কদর ছিল বাঁশের। প্রধানত ঘর, বেড়াসহ নানান ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরিতে বাঁশই নির্ভরযোগ্য প্রাকৃতিক উপাদান ছিল।
বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির প্রতীক বাঁশ। সময় এখন বদলে গেছে। লোকজীবনের খুব কম দিকই ছিল যেখানে বাঁশের তৈরি সামগ্রী ব্যবহার ছিল না। বাঁশ দিয়ে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি হয়। প্রকৃতির চির স্বাস্থ্যসম্মত উপকারী উপাদান বাঁশের কাছে আজ আর আগ্রহী নয় মানুষ। নানাবিধ অবহেলায় আমাদের প্রকৃতি থেকে বাঁশ ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে।
বাংলার প্রকৃতিতে জন্ম নেওয়া বাঁশের ছিল সোনালি অতীত। আমাদের সংস্কৃতিতে বাঁশ শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি লোকশিল্পের অধ্যায় বাঁশকে ঘিরেই রচিত। সাধারণত গ্রামের লোকেরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। নিত্য ব্যবহার্য এই বাঁশ কালক্রমে লোকসংস্কৃতি ও কারুশিল্পের প্রধান উপকরণ হয়ে উঠেছিল। বাঁশের তৈরি এই শিল্প দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের অন্যতম প্রধান জীবিকার মাধ্যম ছিল।
এর গৌরবোজ্জ্বল কার্যকারীতাকে আজ গিলে খেয়েছে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ প্লাস্টিক। জেনে বা না জেনে উপকারী বাঁশের থেকে মানুষ ক্রমশই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ক্ষতিকর প্লাস্টিকের দিকে। সবকিছু বিবেচনায় রেখে পুনরায় বাঁশের ডেরায় প্রত্যাবর্তন সহজসাধ্য নয়।
এখনও সীমিত পরিসরে হলেও বাঁশের প্রচলন রয়েছে। কোথায় ভালো জন্মে বাঁশ? সমতলভূমিতে? নাকি টিলাময় জলাভূমির ধারে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বাঁশ হলো ঘাস পরিবারের একটি উদ্ভিদ। ছড়া বা নদীর ধারে বাঁশ ভালো জন্মে, কারণ সেখানে পর্যাপ্ত পানি পায়। ছড়ার বাঁকে পানি জমে, পলি জমে। ফলে বাঁশের গ্রোথ (বেড়ে ওঠা) এবং হেলথ (স্বাস্থ্য) খুব ভালো হয়। ছড়া বা নদীর পাড়ে বাঁশ লাগানোর অর্থই হলো এর পাড় যেন পানির আঘাতে না ভাঙে। বাঁশ দ্রুত বংশবিস্তার করে এবং গুচ্ছমূল থাকার কারণে মাটিকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়। একটা বাঁশ লাগলে কিছু দিন পরে এক হাজার হয়ে যায়। ওরা কচুর লতির মতো বাড়ে এবং গুচ্ছ তৈরি করে ফেলে। গুচ্ছ হলে সুবিধা হয় সে পুরো পাড়টাকে সহজে আটকিয়ে রাখতে পারে। অর্থাৎ বাঁশের গুচ্ছগুলো ছড়ার পাড়ের মাটির ক্ষয়রোধ করলো।
বাঁশের প্রজাতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ২৫-২৬ প্রজাতির বাঁশ পাওয়া যায়। এর ভেতরে মোটা আকৃতির বিদেশি প্রজাতিও দু-একটি ঢুকে পড়েছে। কালি বাঁশ, ডলু বাঁশ, পারুয়া বাঁশ, মৃতিঙ্গা বাঁশ, মুলি বাঁশ, তল্লা বাঁশ, নলু বাঁশ প্রভৃতি জাতের দেশি প্রজাতির বাঁশ। বাঁশের মোটামুটি অনেক ব্যবহার রয়েছে। ওই মসজিদ থেকে প্রক্ষালন কক্ষ কিংবা কবর পর্যন্ত বাঁশের ব্যবহার।
বাঁশের ব্যবহারকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ক্ষতিকর প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে সোচ্চার ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।
তিনি জানান, প্লাস্টিক এসে আমাদের বাঁশের ব্যবহারটা অনেক কমে গেছে। আমি সেটাই বলে আসছি যে, প্লাস্টিক বন্ধ করলে আমাদের বিকল্প ব্যবহারটাকে বের করতে হবে। আমরা আগে ঝুড়িতে বাজার করতাম। এখন তাহলে আমরা ঝুড়ির ব্যবহারের প্রচলন ফিরিয়ে নিয়ে আসি। প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে আমরা বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহার করতে পারি। বিদেশেও এর প্রচলন রয়েছে। যাকে ‘বাসকেট’ বলে।
এর উপকারিতা প্রসঙ্গে ড. জমীম উদ্দিন বলেন, বাঁশ এক প্রকারের ইকোনমিক প্রোডাক্ট। আমাদের কৃষিজাত ফসলের সঙ্গে বাঁশ খুব বেশি জড়িত। আমাদের ধান, চাল, গমসহ যত ফসল আছে সবই এগুলো ম্যানেজমেন্টের (ব্যবস্থাপনা) সঙ্গে বাঁশ জড়িত। আমরা যে কৃষিপণ্য স্টোর (সংরক্ষণ) করতাম সেটাকে বাঁশের খাড়া বলতো। তারপর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা কৃষিপণ্য নিয়ে যেতে যে বহন ব্যবহৃত হতো সেটাও ছিল বাঁশের।
কনস্ট্রাকশন (নির্মাণ) থেকে শুরু করে মর্ডান (আধুনিক) যত কালচার (সংস্কৃতি) রয়েছে সবখানে বাঁশ ব্যবহৃত হয়। গ্রামীণ একেবারে নিভৃতপল্লি সবখানে বাঁশের ব্যবহার হয়। ফ্ল্যাটের শোভা বৃদ্ধির জন্য ঘরের ইনটেরিওর ডিজাইন বাঁশ দিয়েও করা হয় বলে জানান উদ্ভিদ বিভাগের এই অধ্যাপক।
সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৪
বিবিবি/আরএ