ঢাকা, শুক্রবার, ৬ আষাঢ় ১৪৩২, ২০ জুন ২০২৫, ২৩ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

পর্ব-৩

দ্য ক্রো ইজ হোয়াইট, বেঙ্গল ইজ পাকিস্তান!

তাহির মেহদি, ডন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:২৬, ডিসেম্বর ১৮, ২০১২
দ্য ক্রো ইজ হোয়াইট, বেঙ্গল ইজ পাকিস্তান!

[বাংলাদেশ সম্পর্কে গড়পড়তা পাকিস্তানিরা কী ভাবে? আমাদেরকে তারা কোন নজরে দেখে বা মূল্যায়ন করে? এর সহজ উত্তর— দু’একটি ব্যতিক্রম এবং বুদ্ধিজীবী মহলে ৭১’র ঘটনাবলী নিয়ে সত্যভাষণের কিছু চেষ্টা ছাড়া বাংলাদেশি তথা বাঙালিদের ব্যাপারে তারা নেতিবাচক ধারণায় ‍তাড়িত। পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ডন.কম এর ভাষায়— “পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের চোখের দিকে তাকাতে রাজি নয়।

তারা ১৯৭১ সালের ঘটনাবলীর খুবই খেলো ধরনের এক গল্প-গাথার  আড়ালে নিজেদের লুকোতে চায়, যে গল্পে সেই ঘটনাকে স্রেফ ষড়যন্ত্র হিসেবেই বোঝানো হয়েছে। খুব ভাল হতো যদি একত্রে থাকা যেত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে ষড়যন্ত্র করেছিল কার বিরুদ্ধে? বাঙালিদের করার-ই বা কী ছিল তখন? কীভাবে তারা বিচ্ছিন্নতার মোড়ে পৌঁছালো?” এই কথাগুলো ডন বলেছে সম্প্রতি তাদের প্রকাশিত ‘দ্য ক্রো ইজ হোয়াইট, বেঙ্গল ইজ পাকিস্তান’ শিরোনামের একটি লেখায়। তাহির মেহদি রচিত ৪ পর্বের ওই লেখায় বাংলাদেশ তথা বাঙালিকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। দু’একটি বিচ্যুতি ছাড়া বাংলাদেশ সম্পর্কে গড়পড়তা পাকিস্তানি মূল্যায়নের ব্যতিক্রম এ লেখাটি। আমাদের এখানে স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক মহলটি ’৭১-এ তাদের ভূমিকায় দোষ স্বীকার করতে না চাইলেও এ লেখায় একজন পাকিস্তানি হিসেবে লেখক ’৭১ ও এর আগের সব নেতিবাচক ঘটনাবলির জন্য প্রকারান্তরে প্রায় সব দায়ই পশ্চিম পাকিস্তানিদের বলে মেনে নিয়েছেন। আগ্রহোদ্দীপক এ লেখাটির ভাষান্তর লেখকের অনুমতি নিয়ে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য উপসস্থাপন করা হচ্ছে। ১৫ ডিসেম্বর প্রথম পর্বের পর এটি লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব। বাকি পর্বগুলো ধারাবাহিকভাবে যাবে ]]

যদি তারা বিশ্বাসঘাতকদের নির্বাচন করেই, তাতে দোষের কী

এবং তারা (বাঙালিরা) নির্বাচিত করলো। শুধু একজন নয়, দু’জন নয়, বিশ্বাসঘাতকে পূর্ণ পুরো একটি আইনসভা তারা নির্বাচিত করলো!

পাকিস্তান আসলে নিজে একটি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকেই বিশ্বাসঘাতক চিহ্নিত করার কাজটা শুর করে। জন্মের পর থেকে এমন সময় খুব কমই গেছে যখন তাকে দ্বিধা-দ্বন্ধ-দ্বৈরথ-সংকটে কাটাতে হয়নি। এধরনের সময়গুলোতে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়াগুলো অর্থহীন চেঁচামেচি বই ছিল না।

পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনরা খুব ভালই জানেন তারা ঠিক কী ধরনের রাষ্ট্র আর সরকার চান। তারা এটাও চান যে নির্বাচনমুখী গণতন্ত্র তাদের পরিকল্পনাগুলোকে শুধু আইনগত ভিত্তি দিয়ে যাবে। তবে প্রশাসনের সব ধরনের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তানের দুর্বল গণতন্ত্র নৈতিক সক্ষমতা অর্জন করেনি।

তাদের মনোবাসনা ছিল প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ফল পাওয়ার জন্য গণতন্ত্র বার বার তাদের জন্য ইতিবাচক কাজ করে যাবে। তবে এটা কোনো কাকতাল নয় যে, জনগণ পাকিস্তানের কথিত সব বিশ্বাসঘাতক বা সন্দেহভাজন বিশ্বাসঘাতকদের নিছক জোশের বশেই তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে ফেললো।

এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৪৯ সালের ৭ ‍মার্চ লিয়াকত আলী খান জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবিত সংবিধান উত্থাপন করে এটি পাস করানোর চেষ্টা করেন। করাচিতে আয়োজিত ওই অধিবেশন ছিল ২০ মাস বয়সী জাতীয় পরিসদের  ৫ম অধিবেশন। সেদিন অধিবেশনের প্রথম দিন বিকাল ৪টায় প্রস্তাব উপস্থাপন করে লিয়াকত আলী দীর্ঘ এক বক্তৃতা দেন।

তার বক্তব্যেরে পরপর বিরোধীপক্ষের নেতারা বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের হিন্দু সদস্যরা আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং ব্যাপক প্রতিবাদ জানান ওই প্রস্তাবনার। তারা অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী বুলডোজার চালিয়ে সংবিধানকে ধ্বংস করতে চাইছেন।

জাতীয় পরিষদের সেদিনকার বিতর্কের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি (এগুলো পার্লামেন্টের অফিসিয়াল ডকুমেন্ট):

“মি. শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন— পূর্ব বাংলায় আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি সবিস্তারে বোঝার জন্য আমাদের সময় প্রয়োজন।

তিনি আরো বলেন, বাস্তবিক অর্থে এবার আমরা যখন বাংলা থেকে রওনা করি, এখানে যে এ ধরনের একটি প্রস্তাব পাস করা হবে— সে ধরনের কোনো ধারণাই ছিল না। আমাদেরকে পাঠানো অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে এর কোনও ইঙ্গিতই ছিল না। এখন বাজেট অধিবেশন প্রায় শেষের পথে। অধিবেশনে উপস্থিত সদস্যের সংখ্যাও খুবই কম এখন। আমার প্রদেশের অনেক সদস্য, যেমন মুখ্যমন্ত্রী (পূর্ব বাংলার) যিনি উপস্থিত থাকলে আমাদেরকে খুব ভাল পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিতে পারতেন এ ব্যাপারে— তারা ইতোমধ্যেই হাউস ত্যাগ করেছেন। আমি বুঝতে পারছি, এ বিষয়ে তারা কোনোভাবেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না। কিছু সদস্য আছেন যারা অধিবেশনে একেবারেই যোগ দেননি। এ ধরনের একটি প্রস্তাবের বিষয়ে সঠিকভাবে তাদেরকে নোটিশ দিয়ে জানালে তারা নিশ্চয়ই ‍এর ওপর বিতর্কে অংশ নিতে এখানে উপস্থিত হতেন।
বাস্তবে তাদেরকে কোনও নোটিশই দেওয়া হয়নি।
...তাই আমি এ ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার স্পর্ধা দেখাচ্ছি যে, এ ধরনের একটি গুরুতর বিষয়ের বিবেচনায় এ নিয়ে আলোচনা পরবর্তী অধিবেশন পর্যন্ত স্থগিত করা হোক। সংবিধানের প্রস্তাবনাটি জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রকাশ করা হোক। এরপর পরবর্তী অধিবেশনে এ নিয়ে আলোচনা করা হোক বা এজন্য একটি বিশেষ অধিবেশন ডাকা হোক...

চট্টোপাধ্যায় সাহেবের বক্তব্যের জবাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মি. লিয়াকত আলী খান বলেন, আমি বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, প্রস্তাবনাটি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি করে মাননীয় সদস্যের উপস্থাপিত বক্তব্যে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। অসঙ্গতিগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে, অধিবেশনে উপস্থিত সদস্যের সংখ্যা খুবই কম যেহেতু অধিকাংশ সদস্যই চলে গেছেন, অনেকেই এখানে নেই এবং তাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। আমার মাননীয় বন্ধুর দল সম্পর্কে যতটুকু জানি, একজন ছাড়া সেই দলের প্রত্যেকে এখানে উপস্থিত আছেন, তিনি দুর্ভাগ্যজনক কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তবে তিনি করাচিতেই আছেন। আর তাই সদস্যদের অনুপস্থিতি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, আমি মনে করি এটা সত্যিকারার্থে গুরুত্বপূর্ণ কোনো যুক্তি নয়।

লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের জবাবে চট্টোপাধ্যায় বলেন, আমার কিন্তু কোনো দল নেই। আমি আসলে প্রত্যেকের সঙ্গেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো।

জবাবে লিয়াকত আলী বলেন, আমি ‘দল’ (পার্টি) শব্দটি দিয়ে এই হাউজের অমুসলিম সদস্যদের কথা বুঝিয়েছি এবং আমি আবারো বলছি, তাদের প্রত্যেকে এখানে উপস্থিত আছেন...”

অর্থা‍ৎ প্রধানমন্ত্রী আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল উপস্থাপনের সময় অধিবেশনে অপরাপর মুসলিম সদস্যদের উপস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায়ই আনেননি। আসল কথা হচ্ছে, তিনি চাননি তারা কোনও বিতর্ক করুক এ নিয়ে কিংবা খোদা মাফ করুন, তারা যাতে কোনো বিরোধীতা তৈরি করতে না পারে, তিনি এই চেষ্টাই করেছিলেন।

তাদের কাছে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, (পাকিস্তানের মসনদধারীদের যে কোনো ইচ্ছায়) বিয়ের আসরে জবরজং বেনারশীর জগদ্দলে চাপা পড়া কনেরা উকিল বাবার সামনে যেমনটি করে থাকে, (বাঙালিরা) শুধু মাথা নেড়ে সেরকম ‘কবুল’ বলবেন অন্যরা।

তাদের ধারণা ছিল, ইসলামের নামে করা যে কোনো কিছুর (এমনকি আইনও) বিরোধীতা কোনো ‘সাচ্চা মুসলমানের’ পক্ষে ভাবাও অচিন্ত্যনীয়। কিন্তু অবিরাম নিজেদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার পূর্ব বঙ্গে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘সাচ্চা মুসলমানদের’ সরবরাহে ঘাটতি ছিল।

তারা চাইছিল এমন একটি সংবিধান যা প্রণয়ন করবে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদ।

তারা চাইছিল পাকিস্তান হবে এমন একটি রাষ্ট্রজোট (যুক্তরাজ্য) যেখানে এর সবগুলো অংশ সমতা ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে শাসিত হবে।

তারা চেয়েছিল সর্বোচ্চ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন ‍এবং অর্থেনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে কার্যকর রক্ষা কবচ। তারা চেয়েছিল তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা।

কিন্তু আমাদের এস্টাবলিশমেন্টের কাছে এসবের কোনোটাই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যখনি গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এদেশে, জনগণ বাঙালিদের সব গণতান্ত্রিক দাবিকেই স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছে।

আর তাই, সিকি শতাব্দীকাল যাবত, আমাদের শাসকরা তাদের ইচ্ছার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গণতন্ত্রের চেহারা-সুর‍ৎ পাল্টানোর চেষ্টা করে গেছে।

কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। পাকিস্তানের বেসামরিক-সামরিক শাসকচক্র ১৯৬৯ সালের মধ্যে তাদের পক্ষে মন খারাপ করা সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হলেন— বাঙালিদের কিছু দাবি অন্ততপক্ষে মেনে নিতে হবে।

আর তাই সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হলো, একজন এক ভোট নীতি গ্রহণ করা হলো এবং জনগণ সরাসরি জাতীয় পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করবে(জেনারেল আইয়ুবের পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির বিরুদ্ধে)— তাও মেনে নেওয়া হলো। জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলাকে তার জনসংখ্যার অনুপাতে আসনও দেওয়া হলো। সে সূত্রে তারা ৩০০ আসনের জাতীয় পরিষদে ১৬২ আসনের অধিকারী হলো আর নারীদের সংরক্ষিত ১৩টি আসনের মধ্যে পেল ৭টি। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল আর এতে ফলাফল যা হলো তা ছিল এরকম:

শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দু’টি ছাড়া পূর্ব বাংলার সব আসনে জয় পেল। এটা নিশ্চিতভাবেই ছিল সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের গণরায়। এটা আওয়ামী লীগের অনুসৃত কর্মসূচিকে সর্বোচ্চ স্তরের আইনি ভিত্তি দিল। দলটির নেতারা বিজয়ী হলেন এবং একই সঙ্গে প্রমাণিতও হলেন জনগণের কাছে। তারা কঠিনতর এক লড়াই উল্লসমুখর পরিমণ্ডলে জিতে গেলেন।

নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের প্রথম ‍অধিবেশনের দিন থেকে ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধানের একটি খসড়া তৈরি করার কথা ছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া ‍অধিবেশন আহ্বান করলেন ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ আর আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি কমিটি ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো।

যেহেতু পার্লামেন্টে দলটি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তাই সংবিধানের মূল নীতিগুলো নির্ধারণে ‍তাদেরকে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।

এসব ঘটনাপ্রবাহ সমগ্র পাকিস্তানে না হলেও কমপক্ষে পূর্ববঙ্গে, পাকিস্তানি শাসকচক্রের খবরদারির কার্যকর একটা যবনিকা টানতে পারতো। কিন্তু ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের উদ্ভোধনী অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন আর মুজিব-ভূট্টোর সঙ্গে অর্থহীন আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জেনারেল সাহেব সহসাই গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে বাঙালিদের কাছে তার পরাজয় মেনে নিলেন কিন্তু অন্য ফ্রন্টে তাদের চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার একটি প্রদেশে যুদ্ধ ঘোষণা করলো।

এর মাধ্যমে মুক্তচিন্তার মানুষ যারা নিজেদের রায় প্রকাশে ছিলেন নির্ভীক, তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের তীব্র ঘৃণাত্মক কর্মকাণ্ডের অজস্র অগণন প্রমাণ তারা রেখে গেল। এসব ঘটনা থেকে আপনাদের সঙ্গে একটি শেয়ার করছি।
   
সেনা অভিযান দিন কয়েকের মধ্যেই তা একটি পরিপূর্ণ গৃহযুদ্ধে রূপ নিল যেহেতু বাঙালিরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। ১৯৭০ সালে নির্বাচিত আইনসভা অধিবেশনে বসতে পারেনি। পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে এবং তার ১৬০ জন নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে ৭৬ জনকে অযোগ্য ঘোষণা করে। এর ফলে ৩১৩ জনের জাতীয় পরিষদে ১৬৭ সদস্য নিয়ে নেতৃত্বের আসনে থাকা আওয়ামী লীগকে কেটে মাত্র ৮৪ সদস্যের শক্তিতে নামিয়ে আনা হলো।

এই সংখ্যাটা জাতীয় পরিষদে পাকিস্তান পিপল্‌স পার্টির (পিপিপি) ৮১ আসন (পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে পাওয়া) সংখ্যার কাছাকাছি। অর্থাৎ ব্যবস্থাটা এমন হলো যে—  একটি বিভক্ত আর ঝুলন্ত পার্লামেন্ট ‘সর্বদাই জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে’।

যাহোক, বাস্তবে জেনারেল সাহেব বোকার স্বর্গে বাস করছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি তার এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) সংশোধন করেন পূর্ব বাংলার ‘খালি হওয়া’ আসনগুলোতে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে। কিন্তু ওই সময়টায় অবস্থা এমন পর্যায়ে ছিল যে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে বাংলায় নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল অসম্ভব।

তবে ওই অরাজক আর হজবরল পরিস্থিতিতে ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো যেন সুযোগ পেয়ে গেল। জামায়াতের নেতৃত্বে এ ধরনের ৬টি দল, ওই আসনগুলোতে যৌথ প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বেআইনি এই নির্বাচনে অন্য কোনও দল অংশ নেবে না আর সে সুযোগে তাদের প্রার্থীরা বিনা বাধায় জয়ী হয়ে আসবে বুঝতে পেরে তারা এ পদক্ষেপ নেয়।

আর তাই, নভেম্বরের ১১ তারিখে নির্বাচন কমিশন ওই আসনগুলোর মধ্যে ৬৩টি আসনে একজন করে মাত্র প্রার্থী পেল। তারা সবাই বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় বিজয়ী বলে ঘোষিত হল।

এই আসনগুলোতে দলগত অবস্থান ছিল নিম্নরূপ:
জামায়াতে ইসলামী                      ১৫
পাকিস্তান ডেমেক্রেটিক পার্টি            ১২
পাকিস্তান মুসলিম লীগ-কাউন্সিল         ৭
নেজাম-এ-ইসলামী                       ৬
পাকিস্তান মুসলিম লীগ-কনভেনশন      ৬
পাকিস্তান মুসলিম লীগ-কাইয়ুম          ৫
পাকিস্তান পিপল্‌স পার্টি                   ৫

প্রথমদিকে পিপিপি উপ-নির্বাচনের বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হলেও পরে হরিলুটের মাল হিসেবে এসব আসনের লোভ সামলাতে পারেনি এবং এতে অংশ নেয়। ৬৩টি আসনের ভাগ্য নির্ধারিত হল এভাবে এবং নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিল বাকি আসনগুলোতে নির্বাচন হবে পরের মাসে অর্থা‍ৎ ডিসেম্বরের ৭ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে।

কিন্তু এই রঙ্গমঞ্চে পর্দা পড়ে গেল পশ্চিম রণাঙ্গণে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায়। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন বাদবাকি আসনগুলোর উপ-নির্বাচন স্থগিত করলো। ঢাকায় পাকিস্তান সেনাববাহিনীর আত্মসমর্পণের ৪ দিন পর অর্থাৎ ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভূট্টো একইসঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হলেন। জামায়াতের জীবনকালের সেরা নির্বাচনী বিজয়ের আনন্দে বিষাদ ঢেলে দিয়ে ২৩ ডিসেম্বর ভূট্টো (নভেম্বরে অনুষ্ঠিত) উপ-নির্বচনগুলো বাতিল বলে ঘোষণা করলেন।

তাহির মেহেদি: পাঞ্জাব লোক সুযোগ নামে একটি গবেষণা ও প্রচার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রতিষ্ঠানটি গণতন্ত্র ও শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে

ভাষান্তর: আহ্‌সান কবীর
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৭ ঘণ্টা, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।