আজকের লেখাটি লন্ডন শহর নিয়ে এবং সময় নিয়ে। লন্ডন আমার খুব প্রিয় একটি শহর।
গ্রিনিচ শুধু একটি ভূগোলের নাম নয়। এটি পৃথিবীর শূন্য দ্রাঘিমারেখার কেন্দ্রবিন্দু; এখান থেকেই মানবজাতি সময়কে ভাগ করে নিয়েছে, পরিমাপ করেছে, এবং আন্তর্জাতিক সমঝোতার মাধ্যমে বিশ্বকে এক সূত্রে বেঁধেছে। বলা যায়, “গ্রিনিচ হলো সেই আয়না, যেখানে মানবসভ্যতা সময়কে প্রথম দেখেছিল। ”
চলুন ইতিহাসের পথ ধরে ঘুরে আসি গ্রিনিচ। ১৮৮৪ সালের ওয়াশিংটন ডিসির আন্তর্জাতিক সম্মেলন ছিল সময়ের নতুন ইতিহাস রচনার দিন। বিশ্বের ২৫টি দেশ একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল—গ্রিনিচ মান মন্দির (Royal Observatory) দিয়ে যে দ্রাঘিমারেখা গেছে, সেটিই হবে পৃথিবীর শূন্য ডিগ্রি রেখা।
সেই দিন থেকেই শুরু হলো Greenwich Mean Time (GMT)-এর যাত্রা। জিএমটি কেবল সময় নির্ধারণের একক নয়, এটি হয়ে উঠেছিল সমুদ্রযাত্রা, বাণিজ্য, টেলিযোগাযোগ এবং আধুনিক প্রযুক্তির কেন্দ্রীয় মাপকাঠি।
গ্রিনিচের এই রেখার কারণে বিশ্ব প্রথমবারের মতো একটি অভিন্ন সময় পেয়েছিল। এ যেন মানবজাতির ঐক্যের এক প্রতীক। এক কথায়, “গ্রিনিচে দাঁড়িয়ে মানুষ সময়কে জয় করেছিল। ”
গ্রিনিচ শহরের রূপ নিয়ে বলা যায়, আজকের গ্রিনিচ দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের একটি প্রাণবন্ত স্থান। চেয়ারিং ক্রস থেকে মাত্র ৫.৫ মাইল দূরে অবস্থিত এই শহর একসময় ছিল কেন্ট প্রদেশের অংশ। ১৮৮৯ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত এটি লন্ডন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গ্রিনিচে আর কী কী আছে
মূল আকর্ষণ হচ্ছে—
=> Royal Observatory: সময়ের কেন্দ্রবিন্দু।
=> Greenwich Park: সবুজে মোড়া বিস্তৃত প্রান্তর, যেখানে ইতিহাস ও প্রকৃতি মিলেমিশে আছে।
=> Old Royal Naval College: স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন।
=> টেমস নদীর পাড়: যেখানে দাঁড়িয়ে লন্ডনের অতীত সমুদ্রযাত্রার গৌরব অনুভব করা যায়।
প্রায় বিশ বছর আগে আমি ব্যবসায়িক সফরে গ্রিনিচে এসেছিলাম। আজও মনে আছে সেই প্রথম দিনের আলো—টেমস নদীর ঢেউয়ে খেলা করছিল সূর্যের রশ্মি। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, সময় যেন থমকে গেছে।
মান মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মনে হচ্ছিল আমি যেন অতীতের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। অবশেষে পৌঁছালাম সেই বিখ্যাত শূন্য দ্রাঘিমারেখার সামনে। আমিসহ আমার পুরো টিমের সবাই তখন ক্লান্ত। তবে চমকে উঠলাম।
এক পা পশ্চিম গোলার্ধে, আরেক পা পূর্ব গোলার্ধে। মুহূর্তটি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। মনে হচ্ছিল, আমি যেন একসঙ্গে দুই পৃথিবীর অংশে দাঁড়িয়ে আছি। সেই মুহূর্তে বুঝেছিলাম, সময়কে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়—আর গ্রিনিচ হলো সেই অনুভূতির জন্মভূমি।
কিছু ছবি তুলেছিলাম। অনেকগুলো ছবি হারিয়ে গেছে। ছবিগুলোতে আজও সেই বিস্ময় ভেসে ওঠে—একজন মানুষ, পৃথিবীর দুই গোলার্ধের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সময়কে ছুঁয়ে ফেলেছে।
আমি যদি গ্রিনিচের তাৎপর্য নিয়ে কিছু বলতে চাই তাহলে বলতে হয়, গ্রিনিচের গুরুত্ব কেবল ভূগোল বা বিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নয়।
=> সমুদ্রপথের নিরাপত্তা: নাবিকরা শতাব্দীর পর শতাব্দী এই রেখার উপর ভিত্তি করে দিক নির্ণয় করেছে।
=> আন্তর্জাতিক ঐক্য: বিভিন্ন দেশকে একই সময় ব্যবস্থায় আনার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।
=> সংস্কৃতির ধারক: প্রাসাদ, জাদুঘর ও পার্ক মিলে ব্রিটিশ ইতিহাসের প্রতিটি ধাপকে বহন করছে।
=> সময়ের দর্শন: মানুষকে শিখিয়েছে—সময় একদিকে সীমাহীন, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রিত।
=> এটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতীক, যেখানে এক সম্মেলনের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীকে এক সূচকে বাঁধা হয়েছিল।
=> আর এটি ইতিহাসের ধারক, যেখানে রাজকীয় প্রাসাদ, পার্ক ও জাদুঘর মিলে লন্ডনের অতীতের কাহিনি বলে যায়।
"Time and tide wait for none."
গ্রিনিচে দাঁড়িয়ে এই প্রবাদটি যেন নতুন অর্থ পায়। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, কিন্তু সময়ের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে মানুষ উপলব্ধি করে—সময়ই মানব জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
সাহিত্যিক প্রতিধ্বনি বা সাহিত্য বোধ থেকে বলতে পারি বাংলাসাহিত্যেও সময়ের ধারণা এক চিরন্তন স্রোত। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— “সময় যদি চলে যায়, তা আর ফিরে আসে না। ”
গ্রিনিচ সেই সত্যকে স্পষ্ট করে তোলে। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝি, সময় কেবল ঘড়ির কাঁটা নয়; এটি সভ্যতার স্পন্দন, যা আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে মিলিয়ে দেয়।
লন্ডনের ইতিহাস বলতে গেলে আমরা সাধারণত রাজপ্রাসাদ, যুদ্ধ বা শিল্পকলা নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু যদি একটি উদাহরণের মাধ্যমে লন্ডনের ইতিহাসকে তুলে ধরতে হয়, আমি বলব— “গ্রিনিচ, যেখানে দাঁড়িয়েই মানুষ সময়কে ছুঁয়েছিল। ”
গ্রিনিচ শুধু লন্ডনের নয়, পুরো পৃথিবীর এক গর্ব। এখানে ভ্রমণ মানে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও দর্শনের এক অমূল্য পাঠ গ্রহণ করা। যারা আমার এই লেখাটি পড়লেন, যারা লন্ডন যাওয়ার চিন্তা করছেন, আমার ধারণা তারা এখানে কিছু সময় কাটাতে ভুল করবেন না। আমার ধারণা আমার মতো আপনারও তখন সময়কে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে। এবং ফিরে এসে লিখে ফেলতে ইচ্ছে করবে একটি লেখা, যার আদৌ প্রয়োজন নেই, যারা সময়ের মধ্যে নিজের অবস্থান টের পায় না। এই লেখাটি তখনই পূর্ণতা পাবে যখন আপনি সময়ের মধ্যে ডুব দিতে চাইবেন। আমি জানি না আমি কেন এতদিন পর এই লেখাটা লিখছি। আমার ধারণা কেউ আমাকে চাপ সৃষ্টি করছে এই লেখাটি লিখে ফেলতে। হতে পারে সে হয়তো সময়। পরিশেষে সময় নিয়ে একটি অসাধারণ উক্তি—
এমন কোনোই রহস্য নেই, যা সময় প্রকাশ করে না। — জিন রেসিন
মাহবুব আহমেদ: লেখক, উদ্যোক্তা ও মানবাধিকার কর্মী