বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, তরুণরা যখন দল-মতের ঊর্ধ্ব উঠে কোনো জাতীয় ইস্যুতে একতাবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামে, তখন বিজয়ী হয়েই ঘরে ফেরে। জানি, আজ, এই মুহূর্তে তোমরা রাজপথে পথে আছো, এই লেখা পড়ার চেয়ে সেটিই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তবু খুব সংক্ষেপে ইতিহাসের কিছু কথা লিখে রাখি।
১. ভাষা আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে আর তরুণরাই ছিল এই আন্দোলনের প্রথম উদ্যোক্তা। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৫২ সালে এই আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি পায় এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাষকরা। কার্জন হলের মাত্র কয়েকজন তরুণ ১৯৪৮ সালে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, চার বছরের মাথায় তা রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, রোপন করেছিল স্বাধীনতার বীজ, আর আজ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয় `আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। শুরুটা ছোট আকারের, কিন্তু অর্জনটা বিপুল ও অপরিমেয়।
২. আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর যখন সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তখন শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে তরুণরা গড়ে তোলে শিক্ষা আন্দোলন। কিন্তু সেটি আর সীমাব্ধ থাকেনি ওখানেই। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে তারা প্রণয়ন করেন ১১ দফা। এটি পরিণত হয় সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে, যা ছাত্রদের ১১ দফার আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাও প্রণীত হয়। যে কেউ মিলিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন, এই ছয় দফা আর ছাত্রদের ১১ দফার পার্থক্য খুব বেশি নয়। একটি আরেকটির পরিণত রূপ। ছয় দফা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত জাতিয়তাবাদি আন্দোলনের রূপ লাভ করে, সায়ত্ত্বশাসনের দাবি জোরদার হয়, এবং ১৯৬৯-এ গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতনের মাধ্যমে এটি চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। মনে রাখা দরকার, এই আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল `৬২ সালে, তারপর `৬৬ পেরিয়ে `৬৯। শুরুটা করেছিলেন তরুণরা শিক্ষা বিষয়ক দাবিদাওয়া নিয়ে, শেষ পর্যন্তও ছিলেন তরুণরাই, রোপন করেছিলেন স্বাধিকার আন্দোলনের বীজ।
৩. ৬৯-এর ধারাবাহিকতায় আসে `৭১। তারপর এক দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার ইতাহাস, বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ, অপরিমেয় রক্তপাতের ইতিহাস। আর পরিশেষে বিজয়। সেসব কথা লিখতে গেলে সারাজীবনেও এই লেখা শেষ হবে না। এই যুদ্ধেরও মূল চালিকাশক্তি ছিলেন তরুণরাই।
৪. ১৯৯৮০ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনও শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। আবারও সেই তরুণদেরকেই দেখা যায় অগ্রণী ভূমিকায়। দীর্ঘ নয় বছরের রক্তক্ষয়ী সেই আন্দোলনকে নস্যাত করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে, আপসকামী নেতারা বারবার বিভ্যান্ত করতে চেয়েছেন, কিন্তু তরুণরা পিছু হটেনি। সামরিক জান্তার পতন ঘটিয়ে বিজয়ী হয়েছে তারাই।
৫. ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ডাকে সাড়া দিয়ে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনে বিপুলভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তরুণরা। নানা কারণে সেটি তখন সাফল্য না পেলেও এই আন্দোলনের মাধ্যমে তরুণদের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে যায়। এই দেশকে রাজাকারমুক্ত করতে হবে, কলংকমুক্ত করতে হবে। নানা পর্যায়ে নানা উপায়ে এই আন্দোলন অব্যাহত ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য রাজপথে নামার বিকল্প নেই, এ কথা বুঝে গেছে আজকের তরুণরা। তারা তাই পথে নেমেছে বিপুল সাহস আর দেশপ্রেম নিয়ে।
এই দিন-তারিখ আর সময়ের হিসাবটা দিলাম এটুকু বোঝাতে যে, বিজয় একদিনে আসে না। দীর্ঘ সময় লাগে। তবে আপোসহীন অবস্থান ধরে রাখলে বিজয় অবশ্যসম্ভাবী।
আগেও বলেছি, আবারও বলি : তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে চায়, কলংকমুক্ত হতে চায় - কোনো তরফ থেকে যদি এর বিরুদ্ধে কোনো রকম ষড়যন্ত্র হয় কিংবা কোনোরকম ছলচাতুরি করা হয় তাহলে এই প্রজন্ম আবার রাজপথে নেমে আসবে। আর এদেশের রাজনীতিবিদদের নিশ্চয়ই অজানা নেই - তরুণরা পথে নামলে কী ঘটতে পারে! ৫২, ৬২, ৬৯, ৭১, ৯০-এর কথা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যাননি। জাতীয় ইস্যুগুলোতে তরুণরা দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে একতাবদ্ধ হয়, তাদের যে কোনো সংকল্প শেষ পর্যন্ত সাফল্যই এনে দেয়, এবং তারা কখনো ঘুমিয়ে পড়ে না, পড়েনি - এই কথাটি ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদল গুলোকে মনে রাখার অনুরোধ জানাই।
কাদের মোল্লাকে নিয়ে যুদ্ধাপরাধ-ট্রাইব্যুনালের অগ্রণযোগ্য রায়ের বিরুদ্ধে এবং কসাই কাদেরের ফাঁসির দাবিতে তোমরা নেমে এসেছ রাজপথে, তোমাদেরকে তো এটাই মানায়। শাহবাগ এলাকা অবরুদ্ধ করে রেখেছ তারা, রাখবে বলে ঘোষণা দিয়েছ। অভিনন্দন তোমাদের, প্রিয় তরুণ প্রজন্ম। আমি জানি, তোমরাই পারবে এ জাতিকে কলংকমুক্ত করতে। এ দেশে তরুণদের পরাজয়ের ইতিহাস নেই। কেবলই জয়ের ইতিহাস। জয়ী তোমরা হবেই। শুধু কাদের মোল্লা নয়, সবগুলো যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড চাই আমরা। মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য যে কোনো রায় অর্থহীন। আর একটা কথা মনে রেখো, বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছেড়ো না। আমি, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, সর্বদা, সবসময়।

আহমাদ মোস্তফা কামাল
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৩