রাঙামাটি-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বেড়ে মিয়ানমার ও মিজোরাম ছুঁয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর বান্দরবানের পরতে পরতে যেন নিজেকে মেলে রেখেছে প্রকৃতি। দেশের সর্বোচ্চ দুই পাহাড় তাজিনডং ও কেওক্রাডং, সর্বোচ্চ খাল রাউখিয়াং এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ।
এখানকার মানুষগুলোও যেন প্রকৃতির মতোই উদার, কর্মঠ। পশু-পাখিগুলোর জীবনযাপন পদ্ধতি আর আচরণও যেন সমতলের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। তবে জীবন সংগ্রাম অনেক কঠিন পাহাড়ের ভাঁজে। ১১ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ছাড়াও বাংলাভাষীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আছে পাহাড়ময় বান্দরবান জেলায়। সম্প্রতি বান্দরবান ঘুরে এসেছেন বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম। সঙ্গে ছিলেন স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নূর এ আলম।
বান্দরবান থেকে ফিরে: বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান পানির সঙ্কটে বছরভরই ভুগতে হয় পাহাড়িদের। ভূপ্রাকৃতিক কারণেই দুর্গম পাহাড়ে পানির স্তর সমতলের তুলনায় অনেক নিচে। তাই টিউবওয়েল বসিয়ে পানি সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব। যদিওবা মেলে, তাও আবার বিশুদ্ধ পাওয়া মুশকিল।
তাদের ভরসা ঝিরি, ছড়া, নদী ও পাতকূয়া। আর এসব উৎস থেকে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া কঠিনই বটে। এসব উৎসের পানিই তাদের ব্যবহার করতে হয় খাওয়া থেকে শুরু করে সব কাজে। বিকল্প উৎস না থাকায় পানও করতে হয় এ পানিই।
আর এ পানি পান করার ফলে তারা প্রায়ই ভোগে পেটের পীড়া, জন্ডিস, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি রোগে। পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুযোগ না থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ মানুষগুলোর দুর্ভোগের সীমা থাকে না। প্রতিবছর এসব রোগে প্রাণ হারান অনেক পাহাড়ি।
সরেজমিনে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, থানচি উপজেলার তিন্দু, রেমাক্রি, আদাপাড়া, নাফাখূম, ছোটমোদক ইত্যাদি স্থানে গিয়ে দেখা গেছে- তাদের পানির প্রধান উৎস সাঙ্গু নদী, ঝরণা ও ছড়া। তবে নদীর ওপরই বেশি নির্ভরশীল তারা।
রেমাক্রি বাজার ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, পানিতে একইসঙ্গে চলছে গোসল, কাপড় ধোয়া, থালাবাটি মাজা, তরকারি-মাংস ধোয়াসহ ঘর-গৃহস্থালির সব কাজ। একটু দূরেই ঝিরির তিন চার হাত উপরে পাতকূয়া থেকে চলছে খাবার ও রান্নার পানি সংগ্রহ।
সাধারণত দুইশ’ থেকে তিনশ’ মানুষ নিয়ে গড়ে ওঠা একেকটি পাড়ার মানুষের জন্য রয়েছে একটি করে পাতকূয়া। খাবার, রান্না ও নিত্যব্যবহারের পানির জন্যও অনেক কষ্ট-ঝামেলা পোহাতে হয় পাহাড়িদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক বাড়ি থেকে মাথায় বা পিঠে থুরং ঝুলিয়ে তার মধ্যে লাউয়ের খোলার তৈরি টুই (পানি বহনের ও সংরক্ষণের ছোট পাত্র) নিয়ে পানির জন্য পাতকূয়ায় লাইন দিচ্ছে মানুষ। তবে অপেক্ষাকৃত একটু নিচু পাহাড় ও পাতকূয়ার কাছাকাছি বসবাসকারীরা কলস ব্যবহার করেন।
বহনের সুবিধার্থে উঁচু ও দূরে বসবাসকারীদের ভরসা টুই। সারা দিনের পানি সংরক্ষণের জন্য অনেক সময় তাদের কয়েকবার আসতে হয়। শুধু তাই নয়, ভিড় থাকলে দিতে হয় লাইন। এতে দিনের বড় একটি সময় ব্যয় হয় তাদের। এক্ষেত্রে নারী এবং শিশুদের বেশি দেখা যায়। এ কাজে পুরুষরা আসে খুবই কম।
এ ব্যপারে কথা হয় রেমাক্রি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মালিরাম ত্রিপুরার সঙ্গে। পানি সংকট নিয়ে তার ক্ষোভ অনেক। পানি সংকট নিরসনে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনি কি করছেন বা সরকার এ নিয়ে কিছু ভাবছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “পাহাড়ের এ পানি সংকটের কথা সরকার জানে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয় না। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। এমপি বীর বাহাদুর পর্যন্ত এসে এলাকার এসব কষ্ট নিজের চোখে দেখে গেছেন। কিন্তু তারপরও কাজ হয় না। ”
পানির উৎস আগে কেমন ছিল, এখন কেমন আছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রথম তো পাহাড়ে পানি থাকতে হবে। তারপর বিশুদ্ধ পানি। পাহাড়ে পানি থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার জঙ্গল বা গাছগাছালি। কিন্তু নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে পাহাড়ি ঝিরির পানি এখন দ্রুত শুকিয়ে যায়। দশ বছর আগেও এমন ছিল না। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবৈধভাবে গাছ কাটার ফলে পাহাড় জঙ্গলশূন্য হয়ে যাচ্ছে। পানির জন্য এটা আগে রোধ করতে হবে। ”
সরকারের করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, “এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি, সরকার ফিল্টার করে সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা করুক। কারণ নলকূপ বসিয়ে খুব লাভ হয় না। নলকূপ বসাতে অনেক খরচ হয় এখানে। কিন্তু পানি দু’এক মাসের বেশি পাওয়া যায় না। সরকার যদি নদী বা ঝরণার পানি থেকে কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে পারে তাহলে আমার এলাকার হাজার হাজার মানুষ আর সামান্য পেটের অসুখে মারা যাবে না। ”
দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে ডায়রিয়া, টাইফয়েডের মতো রোগে প্রতি বছর অসংখ্য পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ মারা যায়।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন হিউম্যানেটেরিয়ান পরিচালিত থানচি উপজেলার একটি ক্লিনিকের প্যারামেডিকেল ডাক্তার সিমিয়ন বম বাংলানিউজকে এ ব্যাপারে বলেন, “ডায়রিয়া, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া এসব এলাকার মানুষের প্রধান রোগ। এখানে যেসব রোগী আসে তার নব্বই ভাগই বলা যায় এ দু’তিনটি রোগে ভুগছে। রোগগুলো সবই পানিবাহিত। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাই কেবল এসব রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে পাহাড়িদের। ”
এ ব্যাপারে কথা বলতে উপজেলা স্বাস্থ্য ক্লিনিকে গেলে সেখানে দু’জন অফিস সহকারী ছাড়া আর কাউকেই পাওয়া যায়নি।
বান্দরবান ও থানচিতে বেশ কিছু দিন ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জান।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, জেলা পরিষদের উদ্যোগে জিএফএস (গ্রাভিটি ফ্লো সিস্টেম) এর মাধ্যমে পাহাড়ে পানি সরবরাহের একটি প্রকল্প রয়েছে। এই পদ্ধতিতে উঁচু একটি পাহাড়ে ট্যাংকি করা হয়। পাহাড়ি ঝিরি থেকে পাইপের সাহায্যে সংগ্রহ করা পানি পাইপ লাইনের সাহায্যে বিভিন্ন এলাকায় দেওয়া হয়। ”
তিনি আরও বলেন, “পাহাড়ে পানির স্তর নিচে। উপরন্তু মাটিতে পাথর থাকায় ডিপ টিউবওয়েল বসানো যায় না। তাছাড়া জিএফএসের মাধ্যমে পানি সরবরাহের আগে বিশুদ্ধকরণও করা হয় ওষুধের মাধ্যমে। যদিও সব এলাকায় এটা এখনো করা সম্ভব হয়নি, তবে চেষ্টা চলছে। ”
যদি যেতে চান বান্দরবান: ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে শ্যামলী, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়াসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি সকাল ৭টা- ৯টা এবং রাত ১০টা-১২টার মধ্যে কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬২০ টাকা। সময় লাগবে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা।
থানচি থেকে তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকূম, ছোটমোদক, বড় মোদক পর্যন্ত টানা নৌকা ভাড়া পড়বে দুই থেকে নয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর ইঞ্জিন নৌকায় ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ১২ হাজার টাকা। সময় লাগবে ২ থেকে ৭ ঘণ্টা। তবে মৌসুম ভেদে নৌকা ভাড়া বাড়ে ও কমে। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচশ’ টাকা চুক্তিতে অবশ্যই নিতে হবে একজন গাইড।
বান্দরবানে থাকার পর্যাপ্ত হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ২০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া কটেজ ভাড়া নিয়েও থাকতে পারেন। খাবারেরও সমস্যা নেই। থানচি বাজারের পর যেখানেই যাবেন আপনাকে কারবারি বা কারও বাড়িতে থাকতে ও খেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে সব সহযোগিতা করবে গাইড।
এমন একজন গাইড হলেন- মং মারমা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৭-৪১১০১৩ নম্বরে। ফোন করে যদি বন্ধ পান তাহলে বুঝবেন থানচিতে নেই তিনি। হয়তো কারো গাইড হয়ে গেছেন তিন্দু, রেমাক্রি বা বিজয় কেওক্রাডংয়ে। এক্ষেত্রে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে তাকে বুক করতে পারেন।
বান্দরবানের বৈচিত্র্যময় নানা বিষয়ে জানতে নিচের লিংকগুলি দেখুন
বাংলাদেশ সময়: ১১২৬ ঘণ্টা, জুন ১, ২০১৩
জেডএম/