ঢাকা: চাঁদনী রাতে বসে আছি ডাল লেকের তীরে। দু’নয়ন ভরে দেখছি কাশ্মীরের রূপ।
ভয়েতো অস্থির। এদিক ওদিক তাকাতেও পারছিনা। মনে হয় হাত দুটি বড় মায়াময়। ভাবলাম, কাশ্মীরের এতো রূপ, এখানেও কী এতো কাঁটা! সেই কাঁটায়তো জড়িয়ে পড়লাম না আবার। কেন- গত ষাট বছর ধরে কত না লোক বলিদান দিলো, আমার ভাগ্য কী আবার এমনটি ঘটতে যাচ্ছে না তো।
তবুও তৃপ্ত এ জন্য যে, কাশ্মীর দেখেছি বার তিনেক। দূর দেশি একজন বাঙালির জীবনে এমনি ঘটনা হয়তো কদাচিৎ ঘটে। হাত দু’টি ছেড়ে দিয়ে মানুষটি বাংলা ভাষায় বলে উঠলো- কী আমাকে চিনতে পেরেছেন তো! আমি যে সাকিব চৌধুরী......।
চিনতে কী আর ভুল হয়। ও আরও বলল, সিলেটে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ......... ভাদেশ্বরে যে বাড়ি। বলবো, হঠাৎ এ দেখা আশ্চর্যজনক ঘটনা ছাড়া কিছুই যে নয়।
শাকিব চৌধুরী আমাকে বুকে জড়িয়ে বলল, অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে যেন এক রূপকথার রাজ্য এই কাশ্মীর। এখানে দর্শনীয় স্থানের কী আর অভাব আছে- হাউজ বোটে বসে দেখা মেলে মেঘ পাহাড়ের খেলা.........।
নিশাদবাগ, চশমাশাহী, পরীমহল, শালিমারবাগ, নাগিন লেক সবই মন ভুলায়। জানেন, এই চাঁদনী রাতে দু’চোখ কী যেনো মোহমায়ায় জড়িয়ে পড়ছে। বিকেল বেলায় এক নজর আপনাকে দেখেছিলাম। সেই থেকে ফলো করছি...........। কথা গুলো শুনে মুগ্ধ না হয়ে যে পারিনি!
সাকিব চৌধুরী বললো, চলুন ওই যে হাউজবোট- সারারাত ধরে ওখানেই থাকব। ওই যে দেখছেন, তুষারের মুকুট পরা সবুজ উপত্যকার পাহাড়- আমাকে যে হাতছানি দেয়। চলুন ওখানে দু’জনে মিশে যাই..........। বড্ড ভালো লাগছে যে !
সাকিব চৌধুরীর ইচ্ছাটা যে পূরণ করতেই হলো। হাউজ বোটওয়ালাকে বললাম, সারারাত ডাললেকের রূপ দেখবো- তা কত নিবেন? হাউজ বোট ওয়ালা একটু হেসে- যা খুুশি দেন সেটাই যে নেবো। না দিলেও যে চলবে।
কারণ, আপনারা দু’জনে যে কাশ্মীরের প্রেমিক। যত দূর কল্পনা করেছেন তার চেয়েও বেশি এখানে- কাশ্মীর মাটির ওপর এক স্বর্গ। আপনাদের স্বপ্ন সত্যিই পূরণ হবে যে.....।
দু’জনে হাউজ বোটে গিয়ে বসলাম। দেখেই যাচ্ছি ডাল লেকের রূপ সৌন্দর্য। সাকিব চৌধুরী বললো, ওই পাহাড়ের কাছে যেতে মন চায়। হাউজ বোটওয়ালা জানালো, বাবু, সে কী সম্ভব! কখন যে কী হয় বলা তো যায় না।
আপনি যে কাশ্মীর প্রেমিক সেটা কি সন্ত্রাসীরা বোঝে......... বোঝেনা বলেইতো ওরা সন্ত্রাসী। কেন, ওরা পর্যটকদের ওপর আক্রমন করে। দেশে দেশে কতিপয় মানুষের জন্যই আজ পৃথিবীটা অশান্ত হয়ে আছে।
এক সময় মনে পড়লো বাঙালি মেয়ে গীতা দত্তের গাওয়া- ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে চুপি চুপি বাঁশি বাজে বাতাসে.....” গানের কথাগুলি। যতই রাত বাড়ছে দু’চোখে কি যেন নেশা লাগল- সে নেশা শুধু কাশ্মীরের রূপেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।
আরও তো কিছু ছিল। মনের কথা না হয় মনেই থাক। হাউজ বোটওয়ালা সাকিবের দিকে তাকিয়ে- তুমি কী আমাদের কাশ্মীরী? সাকিব চৌধুরী হাসলো। ক্ষণিক পরে সাকিব চৌধুরী আমার হাত দুটি ধরে চুপি চুপি বললো, আমাকে দেখে কী কাশ্মীরী মনে হয়!
কখন যে সকাল হয়ে গেল, তা বুঝতেই পারিনি। কাশ্মীরের রূপে দু’জন যে ছিলাম মাতোয়ারা। এক রাত হাউজ বোটে ডাল লেকে বেড়ানোর সেই স্মৃতি তো ভোলার নয়! কী করেই বা ভুলবো অপরূপ কাশ্মীরকে। এখনো যে দু’চোখের পাতায় ভাসে কাশ্মীরের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য।
শ্রীনগরের ডাললেক
আজকের শ্রীনগর শহর এক ঘনবসতিপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। শহরের হৃৎপি- হলো ডাললেক। প্রায় ২৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট লেকের ওপরে রয়েছে তিনটি ছোট ছোট দ্বীপ। এগুলো হলো চারচিনার, কবুতরখানা আর নেহরু পার্ক। শিকারায় চেপে ডাললেক দর্শন এক তৃপ্তিদায়ক এবং স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
ডাললেক শুধু তার সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, লেককে কেন্দ্র করে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ঘটে চলা কর্মকা-ও এককথায় তুলনাবিহীন। ডাললেকে নৌকোর ওপর স্থায়ীভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। শিকারায় চেপে দোকানীরা এদের কাছে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি করতে আসে। শিকারায় চেপেই খদ্দেরের কাছে পৌঁছে যায় দরজি, রোগীর কাছে হাজির হয় ডাক্তার। সব মিলিয়ে এ এক অভিনব জলনির্ভর জীবনযাত্রা।
শিকারায় চেপে পর্যটকেরা দেখে নিতে পারেন চারচিনার দ্বীপ, ভাসমান উদ্যান, হজরত বাল মসজিদ, শাল এবং কার্পেটের কারখানা এবং আরও কত কী! ডাললেকের এক সম্প্রসারিত অংশ নাগীন লেক নামে পরিচিত। এখানকার বিলাসবহুল হাউসবোটগুলোতে থাকার রাজকীয় ব্যবস্থা অনেক তারকা হোটেলকে লজ্জা দেবে।
শ্রীনগরের হাউসবোট
কাশ্মীর বেড়াতে গিয়ে ডাললেকের ওপর ভাসমান হাউসবোটে অন্তত একটা দিন না থাকলে শ্রীনগর ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শুধু থাকাই নয়, হাউসবোটের রান্নার স্বাদও নিতে হবে।
শ্রীনগরে হাউসবোট রয়েছে ঝিলম নদীতে, ডাললেকে আর নাগিন লেকে। ডাললেকের ওপর অবস্থিত হাউসবোটে থাকাই শ্রেয়। পর্যটন দপ্তর থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর হাউসবোটের ভাড়া নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
সবচেয়ে সুন্দর এবং বিলাসবহুল হাউসবোটগুলো ডিলাক্স শ্রেণীভুক্ত। এখানে দ্বিশয্যার ঘরভাড়া ২,৫০০ টাকা থেকে শুরু। এরপর রয়েছে ‘এ’ ক্লাস (১,৭০০ টাকা), ‘বি’ ক্লাস (১,০০০ টাকা), ‘সি’ ক্লাস (৭০০ টাকা) এবং ‘ডি’ ক্লাস (৫০০ টাকা)।
সরকারীভাবে ভাড়া নির্দিষ্ট করা থাকলেও পর্যটন মরসুম এবং ট্যুরিস্ট সংখ্যা কম থাকলে হাউসবোটের মালিকের সঙ্গে সরাসরি কথা বললে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাড়া কমানো সম্ভব হয়।
হাউসবোটের বারান্দায় বসে ডাললেককে কেন্দ্র করে চলমান জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করা এক দারুণ অভিজ্ঞতা। হাউসবোটে অগ্রিম বুকিং বা হাউসবোট-সংক্রান্ত কোনো অতিরিক্ত তথ্যের জন্য নিচের ঠিকানায় যোগাযোগ করতে হবে। হাউসবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ট্যুরিস্ট রিসেপশন সেন্টারের বিপরীতে ২৪৫০৩২৬।
কাশ্মীর উপত্যকায় বেশ কিছু অসাধারণ প্রাকৃতিক শোভাম-িত স্থান রয়েছে যাদের কথা পর্যটকরা প্রায় ভুলতে বসেছেন।
এমন কয়েকটি জায়গা হলো আচ্ছাবল (৫৮ কিলোমিটার), কোকরনাগ (৭০ কিলোমিটার), ডাকসুম (৮৫ কিলোমিটার), যুসমার্গ (৪৭ কিলোমিটার), চারার-এ-শরিফ (৩০ কিলোমিটার), উলার লেক (৬০ কিলোমিটার), মানসবল লেক (৩২ কিলোমিটার) এবং দাচিগান ন্যাশনাল পার্ক (২১ কিলোমিটার)।
এসব স্থানগুলোর মধ্যে উলার এবং মানসবল লেক সহজেই ঘুরে আসা যায়। যাওয়া-আসার পথে দেখে নেওয়া যায় ক্ষীরভবানীর বিখ্যাত মন্দির। শ্রীনগর থেকে গাড়ি ভাড়া করে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লে সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসা যাবে।
ফুলের উপত্যকা গুলমার্গ
শ্রীনগর থেকেই দিনে দিনে ঘুরে আসা যায় এমন কয়েকটি জায়গার মধ্যে প্রথম নামটিই হলো গুলমার্গ। শ্রীনগর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গুলমার্গের উচ্চতা ২,৭৩০ মিটার। গুলমার্গকে বলা হয় ফুলের উপত্যকা।
ঘন সবুজ ঘাসে ঢাকা ঢেউখেলানো প্রান্তর, তারপর পাইনবন আর সবশেষে পাহাড়ের বিস্তার, যার খাঁজে খাঁজে জমে আছে বরফ। সব মিলিয়ে ক্যানভাসে আঁকা এক অপরূপ ছবি।
পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে গুলমার্গে ঘুরে বেড়াবার মজাই আলাদা। ঘুরতে ঘুরতেই দেখে নেওয়া যাবে গুলমার্গের বিখ্যাত গল্ফ ক্লাব, রানি মন্দির, সুফি সাধক বাবা রেশির মাজার এবং সাধনস্থল। গুলমার্গ থেকে পথ উঠে গেছে চার কিলোমিটার দূরবর্তী খিলানমার্গে (উচ্চতা ৩,১০০ মিটার)।
পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে অথবা আধুনিক গন্ডোলা বা কেবলকারের যাত্রী হয়ে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় খিলানমার্গে। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকেরা পদব্রজে বা ঘোড়ায় চেপে দেখে আসতে পারেন আলপাথার লেক। এর জন্য অবশ্য একটা গোটা দিন বরাদ্দ রাখা চাই।
গুলমার্গে রাত্রিবাস করতে আগ্রহীদের জন্য রয়েছে রাজ্য পর্যটন দপ্তরের কটেজ ( ২৫৪৫০৭, ২৫৪৪২৪)। গুলমার্গে বেসরকারি হোটেলেরও অভাব নেই। ৬০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে ঘর পাওয়া যাবে এমন কয়েকটি হোটেল হলো : হোটেল হিলটপ ( ২৫৪৪৪৫, ২৫৪৪৭৭), হোটেল পাইন প্যালেস ( ২৫৪৪০৪), ওয়েলকাম হোটেল ( ২৫৪৪১২), হাইল্যান্ড পার্ক হোটেল ( ২৫৪৪৩৭, ২৫৪৪৩০), হোটেল নিদুম ( ২৫৪৪২৮)।
এছাড়া রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল হোটেল যেখানে ঘরভাড়া আরও বেশি। গুলমার্গের এস টি ডি কোড : ০১৯৫৪।
উলার লেক, মানসবল লেক, ক্ষীরভবানী মন্দির শ্রীনগর থেকে গাড়ি ভাড়া করে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লে সন্ধের আগেই উলার লেক-মানসবল লেক আর ক্ষীরভবানী মন্দির দেখে শ্রীনগরে ফিরে আসা যায়।
শ্রীনগর থেকে উলার লেকের দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। পাহাড়, পাইনের জঙ্গল আর পপলার বৃক্ষশোভিত এক সুন্দর এলাকায় উলার লেকের অবস্থান। ১২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট উলার লেক হলো ভারতের বৃহত্তম মিষ্টি জলের হ্রদ।
উলার লেক দেখে যেতে হবে মানসবল লেক। এই সরোবরের প্রাকৃতিক শোভা এবং শান্ত পরিবেশ নির্জনতাপ্রিয় প্রকৃতি প্রেমিকদের মন ভরিয়ে দেবে।
মানসবল থেকে বিখ্যাত হিন্দুতীর্থ ক্ষীরভবানীর দূরত্ব বেশি নয়। কয়েক বছর আগেও নিরাপত্তার অভাববোধ করায় এই মন্দিরে তীর্থযাত্রীরা আসতে চাইতেন না। বর্তমানে প্রচুর হিন্দু ভক্ত দূর-দূরান্ত থেকে এই মন্দিরে দেবীদর্শন করতে উপস্থিত হন।
দেবী দুর্গার অন্যতম রূপ দেবী রাগিণীয়ার মূর্তিই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। মন্দিরসংলগ্ন বাঁধানো কু-ে ভক্তরা দুধ এবং পায়েস ঢালেন। জ্যৈষ্ঠ অষ্টমীতে মন্দিরে বিশেষ উৎসব পালিত হয়। এই সময় ভক্তরা, বিশেষ করে কাশ্মীরী প-িতরা প্রচুর সংখ্যায় ক্ষীরভবানী মন্দিরে এসে হাজির হন।
যুসমার্গ
শ্রীনগর থেকে চারার-ই-শরিফ রোড ধরে চারার-ই-শরিফ দেখে এগিয়ে যেতে পারেন যুসমার্গের পথে। শ্রীনগর থেকে দূরত্ব ৪৭ কিলোমিটার। যুসমার্গে পৌঁছেই চোখের সামনে ধরা দেবে সবুজ ঢেউখেলানো আদিদিগন্ত প্রান্তর।
সেই প্রান্তরের প্রান্তে প্রহরীর মতো চির, দেওদার, পাইনের সারি। গাছের সারির মাথায় বরফ-মাখা হিমালয় গিরিশ্রেণী। শেষ বিকেলের আলোয় দেখা যুসমার্গ মন ভরিয়ে দেবে। জম্মু-কাশ্মীর পর্যটনের বাংলোয় চাইলে একটা রাত থেকেও যেতে পারেন।
যাঁদের হাতে অতটা সময় নেই তাঁরা পর্যটন বাংলোয় দুপুরের খাওয়া সেরে ঘোড়ার পিঠে চেপে এদিক-সেদিক বেরিয়ে পড়তে পারেন। পর্যটন বাংলোর সামনের বোর্ডে ঘোড়ার পিঠে চেপে নানা গন্তব্যে যাওয়ার নির্দিষ্ট ভাড়া লেখা আছে।
চাইলে ঘোড়ার পিঠে চেপে চির, পাইন, বার্চ, দেওদারের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গিয়ে দুধগঙ্গা নদীর পাড়ে পৌঁছতে পারেন। জঙ্গলের মধ্যে নদীর ধারে ছোট্ট দোকানে চা-কফি পাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন
জম্মু-কাশ্মীর পর্যটন নিগমের ট্যুরিস্ট বাংলো আছে। এখানে দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ১,০০০ টাকা, দ্বিশয্যা হাট ৬,০০০ টাকা, তিন শয্যার হাট ৭,০০০ টাকা।
বাংলাদেশ সময় : ১৬১৬ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১৩
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, আউটপুট এডিটর