ঢাকা, সোমবার, ৯ আষাঢ় ১৪৩২, ২৩ জুন ২০২৫, ২৬ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

মৃত্যুপুরী থেকে ফিরে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন!

কামরুল হাসান কাইউম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩:৩১, অক্টোবর ২৬, ২০১৩
মৃত্যুপুরী থেকে ফিরে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন!

ঢাকা: সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসের ছয় মাস হতে চললো। ভবনটি ধসের ঘটনায় নিহত হয় ১২শ’রও বেশি মানুষ।

যারা বেঁচে গিয়েছেন তাদের অনেকেই আর আগের অবস্থায় নেই। যারা শারীরিকভাবে সুস্থ, মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেননি তারা।

ভবন ধসে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের মুখে হাসি ফোটাতে, তাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে, তাদের দক্ষ করে তুলতে ও কাজ খুঁজে পেতে সহযোগিতা করছে (টেকনিক্যাল ভোকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং-টিভিইটি প্রকল্প) আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। এর মধ্যে বেঁচে যাওয়া তিন শ্রমিকের নতুন উদ্যোমে কাজে ফেরার কথা ও তাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন করেছে আইএলও নিউজ। মৃত্যুপুরী থেকে ফেরা সেই শ্রমিকদের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নগাঁথা শোনাতে বিশেষ প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করছে বাংলানিউজ।
Rana-plaza
ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া মিনুর আশপাশের সবগুলোই মৃতদেহ। জীবিত থাকলেও কারও বোঝার সাধ্য নেই তিনি জীবিত আছেন। কারণ, নিস্তেজ দেহ নড়াতে পারছিলেন না তিনি যে কাউকে ডাকবেন অথবা উদ্ধারের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। এজন্য, তখন তিনি বারবার একটি প্রার্থনাই করছিলেন, যেন কেউ বুঝতে পারে তিনি জীবিত আছেন।

এভাবে তিনদিন কোনো খাবার ও পানি ছাড়া মৃতদেহের স্তূপের মধ্যেই শ্বাস ফেলতে হয়েছে তাকে!

যখন অন্য মৃতদেহগুলোর সঙ্গে তাকেও সাভারের আধুর চন্দ্র হাই স্কুল মাঠে রাখা হয়েছিলো, তখন তার চেতনা ছিল কিনা তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। তবে কেবল তার কান্নার ক্ষীণ স্বরে কেউ একজন বুঝতে পারেন, মৃতদেহের সারিতে থাকা মিনু বেঁচে আছেন!

সে লোমহর্ষক ঘটনা স্মরণ করে মিনু বলেন, ভেবেছিলাম কাউকে ডেকে বলতে পারবো না যে, আমি বেঁচে আছি! অনেক মৃতদেহের স্তূপের মধ্যে পড়েছিলাম আমি। এ কারণে, কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবো সে চিন্তাও করতে পারিনি!

মিনু আক্তার রানা প্লাজার চার তলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলসে সাড়ে চার বছর ধরে কাজ করতেন। ভবন ধসের পর তিনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি।

ছয় মাস ধরে পরিবার, আইএলওর টিভিইটি প্রকল্প ও ব্র্যাকের সম্মিলিত সহযোগিতায় সেই দুর্বিষহ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন মিনু।

ভবন ধসে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের বেঁচে থাকতে কাজের প্রয়োজন। তাদের সে প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থায়নে এ কর্মসূচি পরিচালনা করছে আইএলও।

আইএলও ও ব্র্যাকের সুপারভাইজারদের তত্ত্বাবধানে মিনু এখন সাভারে একটি সেলাই দোকানে কাজ করছেন।

এমন দুঃস্বাপ্নিক দুর্ঘটনার পর বেঁচে থাকা মিনু উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, আমি কখনও ভাবিনি আবার কাজ করতে পারবো। কিন্তু এখন আমি নতুন কাজ শিখছি। আমার পরিবারকে দেখতে পেয়ে ও আবার কাজ খুঁজে পেয়ে মনে হচ্ছে আমি বেঁচে আছি।

ভবন ধসে একটি পা হারিয়েছেন আরেক শ্রমিক মিজানুর রহমান। ধসে পড়া রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলসের টেকনিশিয়ানের কাজ করতেন তিনি। কারখানায়ও যোগ দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এক পায়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

আইএলও’র সহযোগিতার মাধ্যমে তিনি এখন শিক্ষানবীশ হিসেবে মোবাইল ফোন ইঞ্জিনিয়ারিং শিখছেন।

স্টিলের রড ও ভাঙ্গা ভবনের মাঝে আটকে থাকার পর মিজানুর কখনও ভাবতে পারেননি, এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই তিনি বের হতে পারবেন। জীবন জয়ের যুদ্ধে তিনি এখন নতুন উদ্যোমে লড়াই করছেন। নতুন চাকরি ও নতুনভাবে ভবিষ্যৎ নির্মাণের কথাও ভাবছেন তিনি।

মিজানুর বলেন, আমি আবার আগের পেশায় ফিরে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা অসম্ভব ছিলো। কেননা আমি অন্য কোনো কাজ পারি না। এখন অর্থোপার্জনের উপায় বের হওয়ায় আমি অনেক খুশি। মোবাইল ফোনের যেকোনো সমস্যা আমি ঠিক করতে পারি।

বাংলাদেশে আইএলও’র আবাসিক পরিচালক (কান্ট্রি ডিরেক্টর) শ্রীনিবাস রেড্ডি জানান, এ দক্ষতা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি একটি শিক্ষানবীশ মডেলের ওপর ভিত্তি করে চলছে। ভবন ধসে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা এখান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।

টিভিইটি পুনর্গঠন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের নতুনভাবে দক্ষ করার জন্য কয়েকটি মডেলের ওপর কাজ করছে। এ মডেলগুলো গড়ে উঠেছে আবার গ্রামাঞ্চলে ও শহরের কেন্দ্রের বাইরে আঞ্চলিক চাহিদা আছে এমন সব ব্যবসার ওপর ভিত্তি করে। বিশেষত, টেইলারিং, মোটরসাইকেল সার্ভিসিং ও মোবাইল সার্ভিসিং। এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকরা অল্প সময়ে দক্ষ হয়ে উঠতে পারবেন এবং নতুন পেশায় ঢুকতে পারবেন।

মিনুর মতো খালেদাও সাভারের একই সেলাই দোকানে কাজ করছেন। আইএলও’র এই কর্মসূচি শুধু তাদের নতুন কাজে দক্ষই করছে না, পাশাপাশি তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ভুলতেও সাহায্য করছে।

ওই দোকানের এক কোনায় এখনও ঝুলছে উজ্জ্বল লাল ও কমলা রঙের তিনটি জামা।

দোকানের সুপারভাইজার শেখ সাদি জানেন ওই জামাগুলো নিতে আর কেউ কখনও আসবে না। কারণ অর্ডার নিয়ে যাদের জন্য জামাগুলো তিনি বানিয়ে রেখেছেন তারা সবাই ভবন ধসের কারণে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে।

সাদিও চেয়েছিলেন ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি সেটা কীভাবে করবেন। তবে আইএলও ও ব্র্যাকের সহযোগিতায় এখন মিনু ও খালেদাকে কাজ শেখানোর মাধ্যমে তিনি তাদের নতুন জীবনের আশার আলো দেখাচ্ছেন!

বাংলাদেশ সময়: ০৩২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৩
কেএইচকিউ/এইচএ/আরকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।