যাদের সময় বা সুযোগের অভাবে বিদেশ ভ্রমণ হয়ে ওঠেনা। ওই সব পাঠকদের জন্য এ লেখা।
কলকাতা: সব সময় পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের একটি জায়গা খাজুরাহ। মধ্যপ্রদেশের ছাতাপুর জেলায় এটি অবস্থিত। হিন্দু এবং কিছু জৈন মন্দির অধ্যুষিত শিল্প কর্মের জন্য শুধু ভারত নয়- গোটা বিশ্বের কাছে এক বিরল নিদর্শন।
কলকাতা থেকে প্রায় ১২৭০ কিলোমিটার রেল পথে যাত্রা করে পৌঁছাতে হবে খাজুরাহ। সময় লাগবে প্রায় ২৬ ঘণ্টা। কলকাতা থেকে আকাশ পথেও যাওয়া যায় খাজুরাহ।
খাজুরাহ শব্দের উৎপত্তির দিকে নজর দিলে আমারা একটি শব্দ খুঁজে পাব “খারজুরাবাহাকা”। এই শব্দটি সংস্কৃত শব্দ “খারজুরা”এবং “বাহাকা” শব্দ দুটির থেকে এসেছে।
‘খারজুরা’ শব্দের অর্থ ‘খেজুর’ এবং “বাহাকা” শব্দের অর্থ যে বহন করে অর্থাৎ ‘বাহক’। মনে করা হয় এই অঞ্চলে ঐতিহাসিক কালে প্রচুর খেজুর গাছ ছিল বলে এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল খাজুরাহ।
আনুমানিক ৯৫০ থেকে ১১৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময় এই মন্দির গুলি নির্মাণ করা হয়। সেই সময় ভারতের এই অঞ্চলটিতে চলছিল চান্ডেলা গোষ্ঠীর রাজত্ব।
এই চান্ডেলা গোষ্ঠী মধ্যভারতের এক বিরাট অঞ্চল শাসন করত। এরা মূলত রাজপুত। ভারতের বিভিন্ন অংশে এখনও এই গোষ্ঠীর মানুষদের দেখা যায়। এদের অনেকে হিন্দু আবার অনেকে শিখ ধর্মের মানুষ।
খাজুরাহ-এর যাত্রাপথ
কলকাতা থেকে রেলে চেপে পৌঁছবেন ‘সাতনা’ স্টেশনে। ১৮ ঘণ্টার মত এই রেল সফর। সেখান থেকে বাসে চেপে আপনাকে হাজির হতে হবে ‘বার্মিঠা’ বলে একটি জায়গায়। সময় লাগবে সাড়ে ৮ ঘণ্টা।
তবে এই যাত্রা আপনাকে ক্লান্ত করবে না। বরং আপনার পর্যটক জীবনের একটি স্মরণীয় যাত্রা হতে পারে এই সাড়ে ৮ ঘণ্টা। ভাড়া গাড়িতেও যেতে পারেন।
কারণ বাস রাস্তাটি ‘পান্না রিজার্ভ ফরেস্ট-এর মধ্যে দিয়ে। সবুজ গভীর অগভীর জঙ্গল চোখে পড়বে বাসের জানালা দিয়ে। চোখে সামনে হাজির হবে বড় বড় ঘাসে ঘেরা অঞ্চল।
জলের শব্দ কানে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই চোখে পড়বে ঝরনা। আর সেই ঝরনার পাশে ধরা দিতে পারে একদল হরিণ।
পান্না রিসার্ভ ফরেস্ট ব্যাঘ্র প্রকল্পের জন্য বিখ্যাত। ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী ৪০টি বাঘ আছে এই অভয়ারণ্যে। দেখা হয়েই যেতে পারে কোন পথ চলতি ভাল্লুক পরিবারের সঙ্গে।
হাতে কিছুটা সময় থাকলে খাজুরাহ যাবার পথে দুই দিন কাটিয়ে যেতে পারেন এই অভয়ারণ্যে।
তবে বাঘ ভাল্লুকের সঙ্গে দেখা না হলেও অবশ্যই দেখা মিলবে বেশ কিছু বাঁদরের। তবে তারা সাধারণত বাসের কাছাকাছি না আসলেও অনেক সময় কোন কোন অতি উৎসাহী বাঁদর বাসের যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ জমাতে চেষ্টা করে। তবে সেই আলাপ করার চেষ্টা মানুষদের চোখে বাঁদরামি মনে হতেই পারে, তাই একটু সাবধান থাকবেন।
তবে নানা রঙের পাখি দেখে মন জুড়িয়ে যাবে। আর দেখতে পাবেন ময়ূর। নীল কণ্ঠের অধিকারী এই ময়ূরদের পেখমের বাহার আপনাকে আনমনা করবেই।
বাসে বা গাড়িতে চড়ে আপনি পৌছাবেন বার্মিঠা। এখানে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে অটোতে চেপে পৌঁছতে পারবেন খাজুরাহ।
ইতিহাস আর শিল্পের এক মিলন স্থলে আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নন্দন তত্ত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
সৃষ্টি এখানে শিল্প রূপে ধরা দিয়েছে। আর শিল্প শিখিয়েছে জীবনের বীজ মন্ত্র। যে মন্ত্র মানুষকে যুগ যুগ ধরে প্রতিকুল পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে এই পৃথিবীর বুকে নিজেদেরকে অস্তিত্ব রক্ষা করতে সাহায্য করেছে।
হিন্দু ধর্মে ‘প্রাণ’ কে অমৃত’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে আর সেই অমৃতস্য পুত্র;র জীবন বিকাশের এক অনাবিল ধর্ম খোদাই করা আছে খাজুরাহের বিষ্ণু মন্দির, পার্শ্বনাথ মন্দির, জগদম্বী মন্দির ,চিত্রগুপ্ত মন্দির প্রভৃতিতে।
খাজুরাহ পৌঁছে প্রথম দিন একটু বিশ্রাম নিন। সন্ধ্যা বেলায় দেখে নিতে পারেন নভরং, বদহা ইয়ি রাই কিংবা দিওয়ারী’র অনুষ্ঠান।
এগুলি সবকটি মধ্য প্রদেশের লোকনৃত্য।
দেখলেই বুঝতে পারবেন ভারতের বুন্দেলখন্ড অঞ্চলের এই বিশেষ নৃত্য ধারা আজও তার নিজস্বতা নিয়ে প্রবল ভাবে বিদ্যমান।
আধুনিকতার প্রবল আগ্রাসনের মধ্যেও এই নৃত্য ধারা এখনও তার ঐতিহ্য বজায় রেখেছে।
দিওয়ারী নৃত্যের একটি বিশেষত্ব হোল নাগরা এবং ঢোল সহযোগে নৃত্যরত পুরুষরা ‘মার্শাল আর্ট’র বিভিন্ন কৌশল প্রদর্শন করে থাকে।
বীররসে জড়িত এই নৃত্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এই নাচের মাধ্যমে শ্রী কৃষ্ণের গোবর্ধন পর্বতকে তুলে গোকুল বাসীদের রক্ষা করার কথা বলা হয়।
বদহা ইয়ি রাই নৃত্যের মূলে আছে রাই বা সরিষা বীজের কল্পনা। সরষে বীজ যখন একটি পিরীচাকার পাত্রে রাখা হয় তখন সেটি ওই পাত্রের মধ্যে ঘুরতে থাকে, ঠিক তেমনি ভাবেই ঢোল মাদল আর গানের সুর এবং লয়ের সঙ্গে নৃত্য শিল্পীরা শারীরিক সক্ষমতার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে।
এছাড়াও দেখতে পারেন শব্দ এবং লেজার রশ্মির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা খজুরাহের ইতিহাস।
ইতিহাসের কথা যখন উঠল, তখন আর একবার চোখ ফেরান যাক তার দিকে। সেই সময় বুন্দেলখন্ডের নাম ছিল ‘জাজেকভুক্তি’।
আগেই বলা হয়েছে চান্দেল রাজারা ছিলেন এই অঞ্চলের শাসক এবং শিল্প সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকও। এই রাজাদের আদি বাসস্থান ছিল মণিয়াগড় অঞ্চলে।
এরা ছিলেন শক্তির উপাসক। এরা মণিয়া দেবীর পূজা করতেন।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এই বংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন রাজা হর্শ। এর ছেলে লক্ষণ বর্মণের সময় তৈরি হয় বিষ্ণু মন্দির। যা লক্ষণ মন্দির হিসেবেও স্থানীয় ভাবে পরিচিত।
লক্ষণ বর্মণের পরবর্তী যুগের রাজাদের হাত ধরে একই রকম নান্দনিকতায় গড়ে উঠেছিল বামন, জাভেরী, আদিনাথ এবং চতুর্ভুজ মন্দিরসহ আরও অনেক গুলি মন্দির।
মনে করা হয় হিন্দু ধর্মে যে চতুরাশ্রমের কথা বলা আছে তার প্রথম ধাপ ব্রহ্মচর্য শেষ করে যখন ছাত্ররা গার্হস্থ জীবনে প্রবেশ করতে যেতেন তখন আগামী জীবন কেমন হবে সেটা এই মন্দির গুলির শিল্প কর্ম দেখিয়ে বোঝান হত।
ভাবলে অবাক হতে হয় আজ গোটা বিশ্বে প্রাক যৌবনে বা বয়ঃসন্ধিতে কিশোর-কিশোরীদের যৌন শিক্ষা দেওয়া নিয়ে যে বিরাট বিতর্ক বর্তমান আছে সেই শিক্ষা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল।
খাজুরাহ মন্দিরগুলো তিন ভাগে ভাগ করা যায়। পূর্ব প্রান্তের মন্দির, দক্ষিণ প্রান্তের মন্দির এবং পশ্চিম প্রান্তের মন্দির।
ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হাতে আসার ফলে খুবই যত্নের সঙ্গে এই মন্দিরগুলো পরিচর্যা করা হয়েছে। এই অঞ্চলের বসবাসকারী মানুষরাও এই মন্দির এবং তার আশেপাশের জায়গাকে খুবই যত্ন সহকারে খেয়াল রাখেন।
মোট ৮০টি মন্দিরের মধ্যে ২৪টি মন্দিরকে উদ্ধার করা গেছে।
মন্দিরের শিল্পকর্ম
যখন শিল্পের রাজপথে সঙ্গী হয় ইতিহাস তখন সেই শিল্পের ব্যঞ্জনা হয়ে ওঠে জীবন ধর্মী। মন্দিরের গায়ে উন্মোচিত হয়েছে সৃষ্টি রহস্যের পরম সত্য।
নানা ব্যঞ্জনায় যেমন একদিকে দেখা যায় সুরসুন্দরীদের বিভিন্ন ভঙ্গিমা, অপ্সরাদের নানা নৃত্যরত বিভঙ্গ অপরদিকে দেখা যায় সৈনিক পরিবেষ্টিত নটরাজ শিব, নাচে মগ্ন গণেশ থেকে সঙ্গমরত নর-নারী।
কোথাও দেখা জায় সুরসুন্দরীরা আরশিতে ব্যস্ত শৃঙ্গার নিয়ে, কোথাও পুরুষ সঙ্গীর মন ভোলাতে নৃত্যের আঙ্গিকে কোথাও ব্যস্ত শিশুর পরিচর্যায় কোথাও বা মিলন মুদ্রায়।
সেই সময়ের শিল্পীদের কথা ভাবলে তাদের সুনিপুণ দক্ষতার কথা চিন্তা করলে অবাক হতেই হয়।
মন্দিরের দেওয়ালে বেশ কিছু অদ্ভুত প্রজাতির জানোয়ার-এর মূর্তি আছে। এদের মাথাটি সিংহের আর শরীরটি অন্য কোন চতুষ্পদ প্রাণীর। এই মূর্তি গুলিকে বলা হয় ‘বেয়াল’।
প্রাচীন বিশ্বাস এই প্রাণী বাইরের শত্রুদের হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষা করত।
এছাড়াও বেশ কিছু মন্দিরের প্রবেশ পথে চোখে পড়ে এক অর্ধ চন্দ্রাকৃতি কয়েকটি শিলা। তার দুই পাশে আছে শঙ্খ। সব কিছুই পাথর খোদাই করে বানান।
মন্দির গুলোর দেয়ালে আছে সংস্কৃত ভাষায় লেখা নানা রকম মন্ত্র। এর মধ্যে বেশির ভাগই বিভিন্ন দেবতার স্তুতি। এখানকার এক একটি মন্দির এক এক জন দেবতাকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
নানা রঙের বেলে পাথর এবং গ্রানাইট পাথরের মন্দির গুলো কোনটি বিষ্ণুর বরাহ অবতার, কোনটি পরশুরাম অবতার, কোনটি সূর্য আবার কোনটি শিব কে উৎসর্গ করা হয়েছে।
মন্দির দেখে প্রবেশ করতে হবে গর্ভ গৃহে। গর্ভ সৃষ্টির মূল আধার । তাই এই জায়গাটি অতি পবিত্র বলে মনে করা হয়।
এর পাশেই আছে চৌষট্টি যোগিনীর বিখ্যাত সেই মন্দির। গ্রানাইট পাথরের তৈরি এই মন্দিরটি খাজুরাহের সবথেকে পুরানো স্থাপত্য।
একটি ৫.৪ মিটার উচ্চতার বারান্দার উপর এই মন্দিরটি অবস্থিত। আধুনিক স্থপতিদের মতে এই ধরনের নির্মাণ পরিকল্পনা খুবই বিরল দৃষ্টান্ত। তবে প্রাচীনতার সাক্ষ্য রেখে এই মন্দিরের অনেকটাই সময়ের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে।
এই মন্দিরের পিছনে পৌরাণিক তত্ত্বটি যথেষ্ট আকর্ষণীয়। যোগ হিন্দু ধর্মের উপাসনার একটি অঙ্গ। উপাসনার এই অঙ্গে বলা হয় ‘মা’ একজন সাধকের প্রথম গুরু।
আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও মহিলাদের শক্তির আধার বলা হয়েছে। তাই নারীর শক্তি ছাড়া সৃষ্টি অসম্ভব। হিন্দু ধর্মে যোগিনী অর্থাৎ নারী যোগ সাধিকাদের দেবতাদের সমতুল্য ধরা হয়।
বেদে অনেক যোগিনীদের উল্লেখ আছে। হিন্দু ধর্মের শাক্য ধারায় যোগিনীরা উপাসনার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্ব পেয়ে থাকতেন। সেই যোগিনীদের পূজার জন্য এই চৌষট্টি যোগিনী মন্দির তৈরি করা হয়েছিল।
জৈন মন্দির গুলো আদিনাথ এবং পার্শনাথকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।
কোথায় থাকবেন
বেশ কিছু হোটেল আছে। আপনার সাধ্য আর সাধ-এর মধ্যে একটিতে ব্যবস্থা করে নিতেই পারবেন। নিজের পছন্দ মত জায়গাটি খুঁজে নিতে অসুবিধা হবে না।
কয়েকটি বিশেষ কথা মাথায় রেখে খাজুরাহ যাবার পরিকল্পনা করবেন।
প্রথমতঃ যে কোন বেড়ানোর ক্ষেত্রেই সঙ্গী নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাজুরাহের ক্ষেত্রে সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়তঃ এই জায়গাটি বিশেষ ভাবে সংরক্ষণ করা। তাই প্লাস্টিক ব্যবহার যত কম করা যায় তার দিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।
এছাড়াও যেকোনো বর্জ্য নিদিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে। থুতু বা পানের পিক ফেললে এই ঐতিহাসিক স্থানকে সঠিক ভাবে রক্ষা করা যাবে না। সেই দিকেও সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে।
যতটা সম্ভব কম স্পর্শ করতে হবে মন্দিরের দেয়াল। তবেই শুধু আপনি নয় আপনার আগামী প্রজন্মও এই অপরূপ শিল্প কর্মকে দেখার সুযোগ পাবে।
তাই ব্যস্ত রুটিনের মাঝে কিছুটা সময় বের করেই ফেলুন। একবার হেঁটে আসুন ইতিহাসের রাজপথে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৩
ভিএস/এসএস/এসআরএস
ফিচার
শিল্পের ছত্রে ছত্রে খাজুরাহ
ভাস্কর সরদার, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।