সিলেট: আকিলা রাইশা চৌধুরী ও আতিকা মাইশা চৌধুরী। বাংলাদেশের গল্প শুনে বেড়ে ওঠা দুই প্রবাসী শিশু।
বাংলাদেশ কেমন? বাংলাদেশের মানুষ কেমন? বাংলাদেশে কি আছে-এমন হাজারো প্রশ্ন আর চোখ জুড়ে রাজ্যের বিষ্ময় নিয়ে সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে বাবা-মায়ের হাত ধরে বাংলাদেশে এসেছে রাইশা-মাইশা। এতদিন শুধু দূরে বসে গল্পে শোনা, এবারই প্রথম বাংলাদেশ দেখা।
লন্ডন থেকে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাড়ি যখন শহরের দিকে, মৃদু মন্দ বাতাসে তখন দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি যেন হেলে দুলে স্বাগত জানায় রাইশা-মাইশাকে।
এমন সবুজের সমারোহে যেনো হারিয়ে গেছে শিশুদু’টি। সঙ্গে বাবা মা এবং তাদের বড় বোন আজিজা রায়হানা চৌধুরী ও আমিরা লাবিবা চৌধুরী।
মনের আনন্দে মাইশা বলেই ফেললো ‘ওয়াও বাংলাদেশ’। গল্পের বাংলাদেশের চেয়ে সত্যিকারের বাংলাদেশ হাজার হাজার গুণ বেশি সুন্দর। বাংলাদেশের মানুষ সুন্দর। বাংলাদেশ সুন্দর। সুন্দরের কোলে কাটাবে তাদের তিন সপ্তাহ। নানাবাড়ি, বাবা-মায়ের নানাবাড়ি, খালার বাড়ি আর কত বাড়ি তাদের জন্য অপেক্ষায়!
কেউ অপেক্ষায় প্রিয় বোনের, কেউ ভাইয়ের। দেখতে না পেয়েই কেটে গেলো এক যুগ। এবার মনভরে কাছে টেনে দেখা আর কথা বলার সুযোগ এলো। তাই বিমানবন্দরে আগে থেকেই ছুটে গেলেন রাইশা-মাইশার মা আনোয়ারা বেগম রুলীর বড় বোন মিলি বেগম ও সুফিয়া বেগম সেপু। সঙ্গে বিমানবন্দরে গেছে তাদের ছেলে-মেয়েরাও।

তাদের বুঝিয়ে বলা হয়- এগুলোর কোনটি রিকশা, আর কোনটি অটোরিক্সা। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশের রাস্তাঘাট কেমন হয় কিছুক্ষণ পরেই হাড়ে হাড়ে টের পেলো তারা।
রাস্তার ভোগান্তিতে চোখে বড্ড ঘুম। তাদের গন্তব্য তখন সিলেট জেলা শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা জকিগঞ্জ। জকিগঞ্জ মূল পৌর শহরের রাস্তার বেহাল দশায় হাঁপিয়ে উঠলো তারা। দু’চোখ ভরে দেখা সবুজ সুন্দরের বাংলাদেশে অসুন্দর শুধু এই রাস্তাঘাট। অবহেলা ও উন্নয়ন বঞ্চণার চিত্র তারা সহজে মেনে নিলো না।
রাইশা-মাইশার বাবা আব্দুস শুকুর চৌধুরী আজাদ বললেন, আরও ১১ বছর আগে যখন বাংলাদেশ দেখেছিলেন তখন রাস্তাঘাট আরও প্রসস্ত। ঘরবাড়িগুলো ছিলো বড়বড়। এখন মানুষ বেড়েছে। ঘনবসতি হয়েছে। বেড়েছে যানবাহন। টেম্পু পরিণত হয়ে যেনো রূপ পেয়েছে লেগুনার। ব্যাটারি চালিত রিকশা যোগ হয়েছে। তাদের কাছে আরও অদ্ভুত একটি গাড়ি টমমট।
রাইশা-মাইশাদের আনন্দময় এক জীবন কাটছে এখন বাংলাদেশে। কিন্তু হরতাল আর সহিংসতায় হতবাক বাংলাদেশি বংশদ্ভূত শিশু ও তাদের বাবা মা। যখন বেড়াতে বের হবে, অনেক দিনের দূরত্ব ঘোঁচাতে যখন রাইশা-মাইশার বাবা-মা পা বাড়াবেন তাদের কতোকালের আপন আত্মীয় পরিজনের বাসায় তখন হরতাল তাদের গতি রোধ করে।
৯ নভেম্বর বাংলাদেশ ছেড়ে আবার লন্ডনে পাড়ি জমানোর কথা থাকলেও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকটে সেই যাত্রা এখনও অনিশ্চিত।
তবুও বাংলাদেশ! রাইশা-মাইশার মাতৃভূমি। নাড়ির টানেই হয়ত এত কিছুর পরও তাদের নিজেদের দেশ দেখার সখ মেটে না। তার পূর্বপুরুষের বাড়ির টিনের চালার নিচে যে মমতা লুকিয়ে আছে, পাশের ধানক্ষেতভরা সবুজে আছে অপরিসীম শান্তি, সেই মততা ঘেরা শান্তিময় বাংলাদেশ তাদের স্বপ্নের দেশ।
তারা এখন জকিগঞ্জে। দেশের সর্ব উত্তর-পূর্বের জেলা সিলেটের উত্তর-পূর্বের উপজেলা জকিগঞ্জ। কুশিয়ারা তীরবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জ এখনও উন্নয়ন বঞ্চনা নিয়ে ধুকছে। তার সড়ক ও গ্রামীণ রাস্তায় উন্নয়ন হচ্ছে না বছরের পর বছর।
সেই ভঙ্গুর বেহাল পথঘাটের দুঃখ ভুলতে রাইশা-মাইশা ঘুরে বেড়াচ্ছে মেঠোপথে, জলভরা দিঘির পাশ ঘেষে। ডিঙি বেয়ে স্বচ্ছ জলে ওপর দেখছে নিজের প্রতিচ্ছবি। পুকুর থেকে মাছ ধরে রান্না। এগুলো যেনো রাইশা-মাইশার চোখে স্বপ্ন। তাদের দুপুরের খাবার তালিকায় আছে ছোটমাছ আর দেশি মুরগি, বলপিঠার খাবার-দাবার।
তাদের সঙ্গ দিতেই যেন বাড়ির উঠোন জুড়ে ভির করে শালিক-চুড়ই। বাংলাদেশ মানুষ, সবুজ বাংলাদেশের পুকুর-জল-দিঘিতে তিন সপ্তাহ কাটিয়ে সাত-সাগর ১৩ নদী পাড়ি দেবে রাইশা-মাইশা। তাদের চোখে কেমন লেগেছে এই ৪৭ হাজার বর্গমাইলের একখণ্ড বাংলাদেশ। প্রথম যেমন ‘ওয়াও বাংলাদেশ’ বলেছিলো-শেষেও কি বলবে তাই!
রাইশা-মাইশাদের মতো হাজার হাজার বাংলাদেশি বংশদ্ভূত শিশু-কিশোর তাদের মনে বাংলাদেশকে লালন করে। ভালোবাসে বাংলাদেশ। তাদের মা-বাবাও স্বপ্ন দেখেন এমনটাই।
রাইশা-মাইমার বাবা আব্দুস শুকুর চৌধুরী আজাদ জানালেন আরও স্বপ্নের কথা। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সম্মান বাড়াতে চান তিনি। তার চার মেয়ের যেকোনো একজনকে কাউন্সিলর বানাতে চান। তার সেই স্বপ্ন হয়তো একদিন সফল হবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এরকম হাজার হাজার বাংলাদেশি বংশদ্ভূত রাইশা-মাইশার ভালোবাসায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৩
এসএ/এসএটি/এমজেডআর