ঢাকা, সোমবার, ৯ আষাঢ় ১৪৩২, ২৩ জুন ২০২৫, ২৬ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

শঙ্খ চন্দ্রের সবজি টানা ঘোড়া

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩৫, নভেম্বর ২, ২০১৩
শঙ্খ চন্দ্রের সবজি টানা ঘোড়া

ঢাকা: রাত সোয়া ৩টা। হাতিরঝিলে ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দে রাতের স্তব্ধটা ভেঙ্গে যায়।

কাছে ‍আসতেই গাড়োয়ানের পাশে গুটিসুটি বসে থাকা এক মধ্যবয়স্কা স্পষ্ট হন। পেছনে তার বস্তাবোঝাই শাক। হিসেব মেলাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কী হতে পারে ব্যাপার!
 
রাখঢাক না রেখেই গাড়োয়ানের কাছে জানতে চাওয়া, এত রাতে হাতিঝিলে? জবাব মেলে, ‘পেটের দায়ে বাজান। কারওয়ান বাজারে গেছিলাম, শাক কিনতে। মেরুল বাজারে বিক্রি করবো। সঙ্গে আমার পরিবার কানন বালা। ’
 
তাই বলে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে শাকের ব্যবসা! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘শরীর সায় দেয় না, তাই রিক্সার হ্যান্ডেল ছেড়েছি। বলতে গেলে বাধ্য হয়েই ছাড়তে হয়েছে। কারণ, রিক্সা চালাইতে জোর পাই না। আর যাত্রীরাও রিক্সায় উঠতে চায় না। ’
 
অনেক কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে ঘোড়া কিনেছেন শঙ্খ চন্দ্র। ইচ্ছে ছিল টমটম কিনে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবার। কিন্তু তা হয়ে উঠছে না। আপাতত তাই ঘোড়াকেই শাক সবজি টেনে বেড়াতে হচ্ছে!
 
ঘোড়ার পেছনে ঠেলাগাড়ি লাগিয়ে শাক বিক্রি করেই চলছে শঙ্খ চন্দ্রের সংসার। খেয়ে না খেয়ে ১০ হাজার টাকা জমা করেছিলেন টমটম কিনবেন বলে। কিন্তু হঠাৎ অসুখে পড়ে বেশিরভাগ টাকা শেষ হয়ে যায়।
 
ভাগ্যবঞ্চিত শঙ্খ চন্দ্র থাকেন রাজধানীর আনন্দনগর (মেরুল) এলাকায়। তার আদি নিবাস ছিল ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার মালিডাঙ্গা গ্রামে। অভাব তাড়নায় গ্রাম ছাড়েন। রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আসেন ১৯৯৫ সালে।

ঢাকায় এসে রিক্সা চালক হিসেবে নাম লেখান। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভালোই চলছিল। কিন্তু এরপরই বিগড়ে যায় শরীর। নানা রকম অসুখ দানা বাঁধে।
 
সঞ্চয়ের ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন ঘোড়াটিকে (লালবাহাদুর)। কিন্তু কিনতে পারেননি টমটম। তবে ছাড়েননি টমটম কেনার ইচ্ছা।

শাকের ব্যবসার দেখাশোনা করেন স্ত্রী কানন বালা। আর শঙ্খ আর্থিক বিনিময়ে বিকেলের আনন্দনগরে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ঘোড়ার পিঠে তোলেন। এই করে স্বামী-স্ত্রীতে টাকা জমানো হচ্ছে টমটম কেনার।
 
প্রতিদিন রাত ১২টায় কারওয়ান বাজারে যান এই দম্পতি। ফেরেন রাত ৩টায়। এই দম্পতি ইতোমধ্যেই তাদের বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি ২ মেয়ে ও ১ ছেলেকে করাচ্ছেন পড়াশোনা। তাদের ভাষ্যে, ‘ইচ্ছা আছে কষ্ট হলেও ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর। ’
 
শঙ্খ জানান, লালবাহাদুর তাদের আরেক ছেলে। নিজের সন্তানের মতোই তারা যত্ন নেন তার। লালবাহাদুরকে দেখেও অবশ্য সে যত্নের স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। শঙ্খ চন্দ্রের চেহারা মলিন দেখালেও হাতিরঝিলের আবছা আলোতেও লালবাহাদুর ঠিকই চিকচিক করছিল!
 
এমনকি, লালবাহাদুর নাম ধরে ডাকলে মাথা তুলে ও নাড়িয়ে সাড়াও দেয় সে! যেতে বললেই যায়, আর ডাকলেই কাছে আসে এমনই এক ঘোড়া সে, জানালেন শঙ্খ চন্দ্র। দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতেই দু’দফায় ডেকে ও তাড়িয়ে এসব পারদর্শিতার প্রমাণও দেখান তিনি।

এ শহরেই অনেকে আছেন যারা এক বৈঠকেই লাখ লাখ টাকা ওড়ান। আবার মাত্র ৩০হাজার টাকার মূলধনের অভাবে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন না কেউ! তবু জীবন ও জীবিকার তাগিদ বলে কথা— ছুটে চলছে শঙ্খ-কানন আর লালবাহাদুরের নৈশ সংসার।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১৩
ইএস/টিকে/এমজেডআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।