ঢাকা, রবিবার, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৫ জুন ২০২৫, ১৮ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

চা-শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা-২

অসুস্থ হওয়া অপরাধ, নেই নারী ডাক্তার

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫:৩৯, মে ১, ২০১৪
অসুস্থ হওয়া অপরাধ, নেই নারী ডাক্তার ছবি: নূর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: বেলা তখন ১১টা। তুলাবতি, লক্ষ্মী, মঙ্গলা, শেফালী এসেছেন চা বাগানের চিকিৎসা কেন্দ্রে।

রয়েছেন আরও অনেকে। অধিকাংশের জ্বর, বুকে ব্যথা। তাতে কী। মেডিকেলের সামনের বারান্দায় এভাবেই বসে থাকতে হবে দুপুর ২টা পর্যন্ত। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে একবার এসেছিলেন ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তার থাকেন ৭টা পর্যন্ত। মাঝে কয়েক ঘণ্টার বিরতি দিয়ে আবার হাজিরা।

শরীর খারাপ থাকার কারণে কাজে যেতে পারেন নি এরা কেউ। বছরে ২০ দিন সিক লিভ। এর বাইরে একদিন কাজে যেতে না পারলে সেই পুরো সপ্তাহের বেতন বন্ধ! আর যে ২০ দিন অসুস্থতার কাজে যেতে পারবে না সেই ক’দিন হাজিরা দিতে হবে মেডিকেলে। বসে থাকার, চলাফেরা করার অবস্থা থাক বা না থাক। তাও আবার এসে বসতে হবে মাটিতে। বেশি অসুস্থ হলে সুচিকিৎসার জন্য কালীঘাটের ডিএমডি হাসপাতালে নেওয়া হয়।

আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাও আবার রোগীদের নিজ খরচে। পরবর্তীতে চিকিৎসা বাবদ বিল জমা দিলে তা কেটে-ছেটে মাস দু’মাস পরে বাগান কর্তৃপক্ষ এসব বিল পরিশোধ করে।  

অসুস্থ্ হলে প্রত্যেক রোগীর বেড, খাওয়া-দাওয়া, ওষুধ দেওয়ার কথা ফ্রি। কিন্তু মেডিকেলে অধিকাংশ ওষুধই থাকে না। কিনতে হয় বাইরে থেকে। আর যেগুলো থাকে সেগুলো কম দামি ওষুধ। এসব অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

সরেজমিনে মেডিকেল গিয়ে পাওয়া যায় এসব তথ্যের সত্যতা। রোগীরা গায়ে জ্বর, ব্যথা নিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই সকালে ডাক্তার দেখানোর পর আবার এসেছেন মেডিকেলে। কারণ তারা যে অসুস্থ এটা যেন চোখের সামনে থেকে, কষ্ট প্রকাশ করে প্রমাণ করতে হবে। ব্রিটিশ আমল থেকেই চলছে এই অমানবিক নিয়ম।

চিকিৎসা নিতে আসা রাধামনি বলেন, সকালে একবার এসেছিলাম। কি করবো নিয়ম থাকায় জ্বর গায়ে আবার ৯টার পর আসতে হয়েছে। বসে থাকতে হয় মাটিতে। দেখেন বেড নেই, থাকার খাওয়ারও ব্যবস্থা নেই। অনেক কষ্ট হয় আমাদের।

ফজিরে আইলে রানি (সকালে একবার এসেছিলাম)। কা করব? নিয়ম তো মানে হই (কি করবো? নিয়ম তো মানতেই হবে)। হাম অসুস্থ হায়, ৯ বাজে তক ২ বাজে পর্যন্ত হাসপাতালে বইঠেলাহেরি (আমি অসুস্থ, কিন্তু আমাকে হাসপাতালে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বসে থাকতে হয়)। হাসপাতালমে যদি না বঠকে না রহব সিক হাজরি না পাইব (হাসপাতালে না বসলে সিক হাজরি পাবো না)।

হামকি কিয়া বেশি খাটিয়া না হা (আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে বেড নেই। হিয়া রহেকে জায়গা না হা (থাকার ব্যবস্থা নেই)। থায়েকা কোনো ব্যবস্থা না হা (খাওয়ারও ব্যবস্থা নেই)। ইয়া হাসপাতালকে আইলে সে হামনি অনেক কষ্ট পাইনি (এই হাসাপাতালে আসলে অনেক কষ্ট হয় আমাদের)। .......কথা বলার সময় কষ্টে কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব রাধামনি।

একটানা কাজ করতে হয় বলে বুকে ব্যথা এখানকার শ্রমিকদের অন্যতম সমস্যা। কাজে ঢিল দেওয়ারও উপায় নেই। কারণ ২৩ কেজি পাতা না তুলতে পারলে যে কম মজুরি পাবে। তাই নিজের শরীর শেষ করে হলেও কাজ করা চাই। তাদের হাতের শক্তির ওপর নির্ভর পুরো পরিবার। এছাড়া অতিরিক্ত আয়ের জন্যও তাদের বেশিক্ষণ কাজ করতে হয়। তবে একইসঙ্গে কষ্টের ও মজার ব্যাপার হলো ২৩ কেজি চা পাতি তোলার পর অতিরিক্ত প্রতি কেজির শ্রমমূল্য মাত্র ৩ টাকা!

চা শ্রমিক নেতা বিজয় হাজরা বলেন, প্রতিমাসে মেডিকেলে দুই হাজার টাকার ওষুধ আসার কথা। কিন্তু আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি ১৩শ টাকার বেশি ওষুধ আসে না। অথচ আমরা এতজন মানুষ এই বাগানে কাজ করি। আর প্রতিদিনই কেউ না কেউ অসুস্থ হয়। আর সকালে একবার এসে আবার সকাল ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত হাজিরা দেওয়ার নিয়ম খুব অমানবিক। আমরা এই অবস্থা থেকে নিস্তার চাই।

মেডিকেলে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে মূলত প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন, হিসটাসিন, এন্টাসিড, রেনিটিড, সিপ্রোসিন আসে। বাকি অধিকাংশ ওষুধ আমরা দিতে পারি না।

চা-বাগানে পাতা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত অধিকাংশ শ্রমিক নারী। অসুস্থ হওয়াদের তালিকাতেও এগিয়ে তারা। অথচ মেডিকেলে কোনো নারী ডাক্তার নেই। এতে অনেক সময় লজ্জায় পুরুষ ডাক্তারকে সব রোগের কথা জানাতে পারেন না নারী শ্রমিকরা।

চিকিৎসা নিতে আসা লক্ষ্মী বলেন, এখানে কোনো নারী ডাক্তার না থাকায় আমরা অনেক রোগের কথা বলতে পারি না। তাছাড়া ডেলিভারির সময়ও অনেক সমস্যা হয়। একজন আয়া বা নার্স দিয়ে তো সব কাজ হয় না।
আর এখানে চিকিৎসা নিতে আসা ভুক্তভোগীদের অভিযোগ মেডিকেলে ওষুধ থাকলেও দেয় না। এগুলো গোপনে তারা বিক্রি করে।

ফিনলে টি কোম্পানির বালিশিরা মেডিকেল ডিপার্টমেন্টের (ডিএমডি হাসপাতাল) প্রধান ডা. এম এ মারুফ ওষুধ না পাওয়া সম্পর্কে বাংলানিউজকে বলেন, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। চলতি বছর আমরা আমাদের কোম্পানির প্রায় ৩০টি ডিসপেনসারির জন্য প্রথম পর্বে ১২ লাখ টাকার ওষুধ কিনেছি। গত বছর আমরা কয়েক পর্বে ৩৫ লাখ টাকার ওষুধ কিনে আমাদের কোম্পানির রোগীদের দিয়েছি।   বাগানের নন-ওয়ার্কাররাই অর্থাৎ যারা বাগানের শ্রমিক নয় এই সব মিথ্যা অভিযোগ তুলে থাকে।

তিনি আরও বলেন, চা-বাগানের একজন তালিকাভুক্ত শ্রমিককের বাবা-মা, স্ত্রী-স্বামী এবং তার সন্তানরা এই ফ্রি চিকিৎসা সেবা পাবেন। তাই বলে কোনো শ্রমিকদের ভাই-ভাতিজা বা আত্মীয়-স্বজন এই ফ্রি সেবার আওতায় পড়ে না।

চা শ্রমিক রোগীদের দীর্ঘক্ষণ ডিসপেনসারিতে বসিয়ে রাখা সম্পর্কে ডা. এম এ মারুফ বলেন, এটি তো ব্রিটিশরীতি। প্রয়োজনের জন্যই এটি এখনো জারি রাখা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, ওই সব রোগীদের নাম ডেকে দ্রুত ছেড়ে দিলে তারা গিয়ে অন্য কাজে লেগে যায়। হয়তো তারা নিজেদের ঘরের কাজ করে। নয়তো অন্য কোথায় গিয়ে যুক্ত হয়ে যায়। ‘সিক’ লেখাবার জন্য দুপুর পর্যন্ত তাদের বসিয়ে রাখলেও তারা কিন্তু তাদের একদিনের বেতনটা ঠিকই পাচ্ছে।  
  
বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ২০১৩ সালের ০৮ নভেম্বর চা-শ্রমিক দয়া হাজরা গাইনি সমস্যাজনিত কারণে সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। তার চিকিৎসাজনিত খরচ হয় ১১ হাজার ১৯৫ টাকা। ৪ মাস পর বাগান কর্তৃপক্ষ ওই বিল কেটে-কুটে মাত্র ৮০০ টাকা দেওয়ার জন্য রাজি হয়। বাগান কর্তৃপক্ষ বলে, পুনরায় তোমরা সিলেট থেকে বিল-ভাউচারগুলো নিয়ে এসো।

মুরালি হাজরা বলেন, আমি একজন গরিব চা-শ্রমিক। তিন বেলা ঠিকমত খেতে পারি না। আমি কীভাবে আবার সিলেট গিয়ে ওই সব বিল-ভাউচার নিয়ে আসবো?       

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও চা-শ্রমিক নেতা রামভজন কৈরী বাংলানিউজকে বলেন, চা-বাগানের শ্রমিকদের পেশাগত কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। নারী চা-শ্রমিকরা খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে পাতা তোলার কাজ করেন। কাজের সময় তারা ঘামে-বৃষ্টিতে ভেজেন। ভেজা কাপড়েই তাদের সারাদিন কাজ করতে হয়। পোশাক পরিবর্তনের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই তাদের। ফলে ছত্রাকজনিত নানা চর্ম রোগে ভুগতে হয় শতকরা ৩০ জন নারী শ্রমিককেই। আর অন্যান্য রোগবালাই তো রয়েছেই।

শ্রমিকদের কথা হলো, ওষুধ কিনে কি লাভ যদি আমরা সেই ওষুধ না পাই।   কোম্পানির ডাক্তার যে কথাই বলুন না কেন প্রকৃত প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সরেজমিনে গিয়ে সেটা উপলব্ধি করা সম্ভব। শ্রমিক ইউনিয়ন ও সরকার যদি এদিকে একটু মনোযোগ দেয় তাহলে সুষ্ঠুভাবে বাঁচতে পারে এসব শ্রমিক।

আগামীকাল পড়ুন: চা-শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা-৩ চোখ অন্ধ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে ‘ঝুঁকি ভাতা’ আড়াই টাকা!

বাংলাদেশ সময়: ০৫১০ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৪

**  চা-শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা-১
বাগানে এখনো ব্রিটিশ শাসন!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।