ঢাকা, শুক্রবার, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৩ জুন ২০২৫, ১৬ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

চা-শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা-৩

চোখ অন্ধ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে ‘ঝুঁকি ভাতা’ আড়াই টাকা!

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪:৪৩, মে ২, ২০১৪
চোখ অন্ধ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে ‘ঝুঁকি ভাতা’ আড়াই টাকা! ছবি : নূর /বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: কোনো রকম নিয়ম না মেনেই চা-বাগানে প্রতিনিয়ত চলছে কীটনাশকের ব্যবহার। এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের দেওয়া হচ্ছে না কোনো রকম সুযোগ-সুবিধা।

কীটনাশক ছিটানো শ্রমিকদের চোখ-মুখই বলে দেয় তাদের অবস্থা কতটা করুণ। প্রতিদিন চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও ঝুঁকি ভাতা পান মাত্র আড়াই টাকা! অথচ পরের দিন চোখ ঠিক রাখার জন্য যে ড্রপ ব্যবহার করতে হয় সেটা দেওয়া হয় না মেডিকেল থেকে। বাইরে থেকে কিনতে হয় অনেক বেশি দামে।

শ্রীমঙ্গলের কয়েকটি চা-বাগান ঘুরে দেখা মেলে কীটনাশক ছিটানোর কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তারা কতটা ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন কাজ করছেন। কিন্তু যাদের পরিশ্রমে চা-বাগানে সবুজ কচি পাতা উঁকি দেয়, কি পাচ্ছে তারা?


চা-বাগানের লেবার আইন ও চুক্তি অনুযায়ী, ‘কীটনাশক ও আগাছানাশক ছিটানোর কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে যারা মূলত ওই দিন ছিটানোর কাজে নিয়োজিত থাকবে তারা প্রতিদিন ২.৫০ টাকা হারে ঝুঁকিভাতা প্রাপ্ত হবে। ’

পুরুষ শ্রমিক যারা চা গাছে ইথিয়ন, থাইওডিন, গ্রামাক্সোন, ইউ-৪৬ প্রভৃতি কীটনাশক ছিটানোর কাজ করেন তাদের বেশিরভাগই কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। যেমন- মুখাবরণ, দস্তানা, অ্যাপ্রোন, চশমা ব্যবহার করেন না। ফলে অনেকেরই চোখ, ত্বক ও শ্বাসতন্ত্রের অনেক ক্ষতি হয়।  


চুক্তিতে আরও আছে, ‘যেসব শ্রমিক কীটনাশক, আগাছানাশক ও অন্য রাসায়নিক দ্রব্যাদি ছিটানোতে নিয়োজিত, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাদের চাহিদা মোতাবেক রাসায়নিক দ্রব্যাদির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য হ্যান্ডগ্লাভস, জুতা, মাস্ক ও অ্যাপ্রন সরবরাহ করবে। সংসদ তার সদস্যদের আরও সুপারিশ করবে ছিটানোর কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রতিরোধমূলক যন্ত্র/কাপড় ব্যবহারে এবং রাসায়ানিক দ্রব্যাদি ছিটানোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজনের জন্য। ’

এ ব্যাপারে ভাড়াউড়া চা-বাগানের কীটনাশক ছিটানো শ্রমিক দুলাল, শংকর, বিমলের সঙ্গে। এদের প্রত্যেকের চোখ যেন রক্তচক্ষু, ফোলা। সকালে প্রত্যেকে কীটনাশক ছিটিয়েছেন।


চোখের কথা জিজ্ঞেস করলে দুলাল বলেন, এমন অবস্থা আমাদের সবসময়ই হয়। ডাক্তারের কাছে গেলে চোখে একটু ড্রপ দিয়ে ছেড়ে দেয়। বাকিটা কিনতে হয় বাইরে থেকে। তাছাড়া নিয়মিত এ ড্রপ দেওয়ায় ভালো না। মালিকপক্ষের কাছে জুতা, গ্লাভস, অ্যাপ্রন চাইলে দিচ্ছি দেব বলে আর দেয় না। আমাদের পেট চালানোর জন্য কাজে যেতে হয়। কি করবো।

শংকর বলেন, যখন কীটনাশক ছিটাই তখন কিছু খেতে পারি না। ক্ষুধা লাগে না। চোখে কম দেখি। আবার ঘুমও বেশি হয়।

তারা জানান, চা-বাগানে প্রধানত কীটনাশক ও আগাছানাশক হিসেবে কুপ্রভিট অক্সাইট, থাডিওন, পারফেকথিওন, গ্রমাইকোন, কারানাইকোন প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়।
 
এসব উপাদান ক্ষতিকর বলেই শ্রমিকদের প্রতিরোধমূলক দ্রব্যাদি সরবরাহ করার কথা। কিন্তু নানা অজুহাতে মালিকপক্ষ তা করে না।


ভাড়াউড়া ও কালীঘাটের চা-বাগানে পরের দিন সকালে গিয়ে দেখা যায় কোনো নিয়ম না মেনেই কীটনাশক ছিটাচ্ছেন কয়েকজন শ্রমিক। কারোরই হাতে নেই গ্লাভস,চোখে চশমা নেই, পরনে নেই অ্যাপ্রন। তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে জানান, মালিক কিছুই দেয় না। আমাদের অনেক সমস্যা হয়। পেটের দায়ে কাজ করি।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুকল্প দাশ বলেন, ‘শুধু চা-বাগান নয়, বাংলাদেশে কীটনাশক যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে আরও সচেতনতার প্রয়োজন। যিনি কীটনাশক ছিটাবেন তার শারীরিক নিরাপত্তার দিকটি অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। স্বাস্থ্য বিভাগ, কৃষি বিভাগ, কীটনাশক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং যে প্রতিষ্ঠানে এ কীটনাশকগুলো ব্যবহার করা হয় -এমন চার প্রতিষ্ঠানকেই সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে কীটনাশকের ক্ষতিকর দিকটি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি ক্ষেত্রে।

আগামীকাল পড়ুন: চা-শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা-৪
খোলা চা-বাগানই টয়লেট, প্রাপ্ত আটার অর্ধেকই ভূষি!

** বাগানে এখনো ব্রিটিশ শাসন!
** অসুস্থ হওয়া অপরাধ, নেই নারী ডাক্তার

বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৬ ঘণ্টা, মে ০২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।