ঢাকা, শুক্রবার, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৩ জুন ২০২৫, ১৬ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

চা-শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা-৪

খোলা চা-বাগানই টয়লেট, আটার অর্ধেকই ভূষি!

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০:৪৫, মে ৩, ২০১৪
খোলা চা-বাগানই টয়লেট, আটার অর্ধেকই ভূষি! ছবি: নূর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’র শ্রমিকদের সীমা নেই কষ্টের। যে সবুজ পাতা মালিকপক্ষের মুখে হাসি ফোটায়, সাধারণ মানুষের চোখের খোরাক মেটায়, যে পাতার লালচে রং শরীরে আনে সতেজতা, সেই পাতা নিঙড়ানো রঙিন পানি শ্রমিকদের কাছে রক্তজল ছাড়া কিছুই নয়!

ন্যূনতম মজুরি ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাদের কল্যাণে দেশের চা দেড়শো বছরে হয়ে উঠেছে অন্যতম শিল্পপণ্য, সেই শ্রমিকরা ব্রিটিশ আমল থেকেই চরম অবহেলিত।

শ্রম আইনে কর্মক্ষেত্রে সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিতের কথা বললেও কোথাও তা মানা হয় না। চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শ্রমিকদের প্রতিদিন কাজ করতে হয়। সেকশন অনুযায়ী ছাউনি ও টয়লেট থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ বাগানে সেটা নেই। নেই পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা। 1_1_4
২০০৯ সালের চা-বাগান শ্রমিকদের চুক্তিনামা অনুযায়ী, ‘অ্যাসোসিয়েশন তার সদস্যদের সুপারিশ করবে যে কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রতিরক্ষা ছাউনি/পাতা ছাউনি, নির্মাণ করার জন্য। কাচা প্রতিরক্ষা ছাউনিকে পাকা ছাউনিতে পরিবর্তন করা এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য যাতে বৃষ্টি, ঝড় প্রভৃতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ’

ভাড়াউড়া ও কালীঘাট চা-বাগানের কয়েকজন নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের দুর্দশার কথা। 2_2_3 
শেফালী, বিদ্যাবতি, জিতনি, রাধা জানান, তারা সবচেয়ে বেশি যে সমস্যায় ভোগেন সেটি হলো টয়লেট সমস্যা। বাগানে কাজ করার সময় প্রতিটি বাগানের একটি নির্দিষ্ট এলাকা পর পর টয়লেট থাকার কথা থাকলেও তা নেই। মালিকপক্ষকে জানালে তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ফলে তাদের চা-বাগানের ভিতরেই প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হয়। এতে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হলেও সেভাবেই তাদের কাজ করতে হয়। কারণ বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই।
3_3_
তারা জানান, খাবার পানির সংকটও এখানে অনেক বেশি। পানি সংগ্রহের জন্য যেতে হয় অনেক দূর। নিজের কাছে সঞ্চিত পানি ফুরিয়ে গেলে বাকি সময় পানি না খেয়েই কাটাতে হয়।
 
তারা আরও জানান, ঝড়-বৃষ্টির সময় এই কষ্ট বেড়ে যায় কয়েকগুণ। নিয়ম আছে ৪/৫ সেকশন মিলে একটি ছাউনি থাকবে দুপুরের খাওয়া ও ঝড়-বৃষ্টির সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্য। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায় ছাউনি আছে ১৩ থেকে ১৮ সেকশন মিলে একটি। ফলে তাদের বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করতে হয়। এতে প্রায়ই হয় ঠান্ডাজনিত অসুখ। দুপুরের টানা রোদ বা বৃষ্টির মধ্যে বাগানের গাছের উপর প্লেট রেখেই তাদের খাবার খেতে হয়।
4_4_
তাছাড়া বাগান অপরিস্কার থাকার কারণে পাতা তোলা ও হাঁটা-চলার জন্য বেশ সমস্যায় পড়তে হয় শ্রমিকদের। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই।
 
এত কষ্ট করে কাজ করার পরও তাদের দেওয়া হয় কোনো চা-পাতা। অথচ বড়লোকের অথবা চা-বাগানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বেড-টি ছাড়া চলে না। যারা এত কষ্ট করে পাতা তোলার কাজটি করে তাদের কিনে খেতে হয় সেই পাতা থেকে উৎপাদিত চা। তারা মাঠের শ্রমিক-এটুকুই তাদের অপরাধ।
5_5
সারাদিন কাজের পর খাবারও তাদের জোটে না ঠিকমতো। চা-বাগানের অধিকাংশ নারী শ্রমিক ভোগেন অপুষ্টিতে। এরই মধ্যে সপ্তাহে কম মূল্যে কয়েক কেজি রেশন হিসেবে আটা পান। কিন্তু দেখা যায় এসব আটার মধ্যে অর্ধেকই থাকে ভূষি মেশানো! ভূষি থেকে আটা আলাদা করার পর বেশি কিছু আর থাকে না। কম দামে রেশন দিচ্ছে এটাই যেন তাদের বড় প্রাপ্তি। কি দিচ্ছে সেটা দেখার বিষয় নয়-ভাবখানা এমন।
 
সুমা হাজরা ও জিতনি জানাচ্ছিলেন এসব কথা। তাদের কথা শুনে তাৎক্ষণিক সত্যতা যাচাইয়ে আমরা চলে যাই তাদের বাড়িতে। গিয়ে দেখা গেল তারা যা বলেছেন তার পুরোটাই ঠিক। আটার স্বাভাবিক রং নেই। টুকনি দিয়ে টোকার পর দেখা গেল সত্যি বেরিয়ে এসেছে ভূষি।
6_6_5
শ্রমিক নেতা বিজয় হাজরা বলেন, মালিকপক্ষ শ্রম আইনকে তোয়াক্কা না করে নিজস্ব আইন তৈরি করে চা-শ্রমিকদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে। যেমন- শ্রম আইনে বলা আছে স্বামী এবং স্ত্রী চা-শ্রমিক হলে দুজনেই আলাদ আলাদা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাদি ভোগ করবে। কিন্তু বাস্তবে এর চিত্র উল্টো।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের ‘টি সেল’ বিভাগের মহা-ব্যবস্থাপক মো. শাহজাহান আকন্দ বাংলানিউজকে বলেন, কোনো চা-বাগানই তার শ্রমিককে জেনেশুনে এমন কখনোই করে না। কারণ শ্রমিকরা চা-বাগানের জন্য সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনিচ্ছা সত্ত্বে হয়তো দু-একটি ঘটনা এমন হয়ে থাকতে পারে। তবে ঢালাওভাবে কোম্পানিকে বা বাগান কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করা কখনো উচিত নয়।

আগামীকাল পড়ুন: চা-শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা-৫
নদীতে গোসলের ছবি তোলে, ঘর চান সবাই

** চোখ অন্ধ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে ‘ঝুঁকি ভাতা’ আড়াই টাকা!
** বাগানে এখনো ব্রিটিশ শাসন!
** অসুস্থ হওয়া অপরাধ, নেই নারী ডাক্তার

বাংলাদেশ সময়: ০০৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।