কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার : কেউ দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিল, কেউবা তৃতীয়। কেউ গিয়েছিল স্কুলে, কেউবা মাদ্রাসায়।
দারিদ্র্য আর অভিভাকদের অসচেতনতায় উপকূল অঞ্চলের বহু শিশু একসময় লেখাপড়া ছেড়ে কাজে যোগ দেয়। লেখাপড়া করার চেয়ে নগদ রোজগারটাই অভিভাবকদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়। কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়ে অনেকেই ছাড়ে লেখাপড়ার গ-ি। উপকূল এলাকায় লেখাপড়া বন্ধ রেখে কাজে যোগ দেয়া এইসব শিশুরাই ‘ঝরেপড়া’ শিশুদের তালিকা দীর্ঘ করে চলে। কক্সবাজারের কুতুবদিয়া পাড়ায় ঘুরে এমন চিত্রই ধরা পড়েছে বাংলানিউজের চোখে।
ওরা বই-খাতা হাতে স্কুলে যাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে। এই শিশুদের কারও কণ্ঠে আবার ক্ষোভ, আমরা লেখাপড়া চালালে আমাদের ঘর চালাবে কে?
তবে এখন চিত্র কিছুটা পাল্টে যাচ্ছে। শিশুরা আবার স্কুলের পথে।
উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় শিশুশিক্ষায় চরম হতাশার মাঝেও কিছুটা আশা জাগে, যখন স্কুলমুখী ঝরেপড়া শিশুরা তাদের স্বপ্নের কথা বলে। মধ্য কুতুবদিয়া পাড়ায় ‘শিখন’ নামের শিশুশিক্ষা স্কুলে আলাপকালে শিশুদের কেউ বললো ডাক্তার হবে, কেউবা আদর্শ শিক্ষক। কেউ আবার বড় সরকারি অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। অথচ ওরা লেখাপড়া ছেড়েই দিয়েছিল; কিন্তু এখন পড়ালেখায় খুব মনযোগী।

কুতুবদিয়া পাড়ায় এমন দশটি বিদ্যালয় পরিচালনা করছে বেসরকারি সংস্থা ‘কোডেক’। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে ‘সাপোর্টিং দ্য হার্ডেস্ট টু রিচ থ্রু বেসিক এডুকেশন-শেয়ার’ নামক কার্যক্রমের আওতায় এ স্কুল পরিচালিত হচ্ছে।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, দিনমজুর ইসমাইল হোসেনের মেয়ে জারিন তাসনিম হেনা (৯), ক্ষুদ্র শুটকি ব্যবসায়ী মনজুর আলমের মেয়ে সোনিয়া (৯), মৃত আবু তাহেরের মেয়ে মেয়ে খাদিজা বেগম (৮), ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ী আবদুস সালামের ছেলে এমরান হোসে (১২)সহ আরও অনেকেই এখনও স্কুলে আসে। বিশেষ করে মায়েদের ইচ্ছায় তারা পূনরায় লেখাপড়া শুরু করেছে।
স্কুলের শিক্ষক রুমা খানম বাংলানিউজকে বলেন, পরিবার ও সমাজের নানা প্রতিকূলতার কারণে এইসব ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারেনি। এদেরকে পূনরায় বিদ্যালয়ে এনে মানসম্মত শিক্ষা দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়াই এই স্কুলের অন্যতম লক্ষ্য।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এই স্কুলের লেখাপড়ায় কী পার্থক্য? এমন প্রশ্নের জবাবে রুমা খানম বলেন, এখানে শিশুদের আনন্দের মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানো হয়। স্কুলে বসেই তারা নিজ নিজ পড়া শিখে ফেলে। পাঠদান প্রক্রিয়ায় রয়েছে বিশেষ কৌশল। শিক্ষার্থীরা স্কুলে ছোটদলে-বড়দলে পড়াশুনা করে জ্ঞান আহরণ করে। লেখাপড়ার পাশাপাশি এরা সঙ্গীত, সাহিত্য, ছবি আঁকা, বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের মধ্যদিয়ে বহুমূখী জ্ঞান অর্জন করে। শিশুদের স্কুলে আসতে উৎসাহিত করা হয়।
কুতুবদিয়া পাড়ার বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ড এই কুতুবদিয়া পাড়ায় কোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এরফলে অভিভাবকদের ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারবেন না। আর্থিক অনটনের কারণে দূরের স্কুলে লেখাপড়া করানো সম্ভব হত না বলে অনেক ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেন। এখন বাড়ির কাছের স্কুলে অনেকেই যেতে পারছে।

অভিভাবকেরা জানান, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাওয়ার ফলে সামাজিক পরিবর্তনের পাশাপাশি পারিবারিক পরিবেশেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণত মায়েদের ইচ্ছায় সন্তানেরা পুনরায় স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। সেই সন্তানেরা যখন স্কুলে গিয়ে কিছু বর্ণ আর বাক্য শিখেছে, তখন মায়েরা বাবাদের ডেকে বলছে, দেখ মেয়ে কেমন সুন্দর করে পড়ছে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া শেখার গর্বে মায়ের মাথা তখন উঁচু হয়ে যায়।
স্কুল কার্যক্রমের লার্নি ফ্যাসিলেটর নূর নাহার মুন্নী বাংলানিউজকে বলেন, স্কুল পরিচালনায় স্থানীয় কমিউনিটি সব ধরণের সাহায্য করছে। স্কুল ঘর স্থানীয়দের অর্থে তৈরি হয়। তবে স্কুলের খাতাপত্র, বই, কলম কোডেক থেকে দেয়া হয়। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না বলেই প্রত্যন্ত এই এলাকায় কাজ করছে শিখন স্কুল। কোথাও শতভাগ আবার কোথাও ৯৯ ভাগ উপস্থিতি রয়েছে এসব স্কুলে।
কোডেক শিখন কর্মসূচি সূত্র বলছে, এই কর্মসূচির আওতায় তিন ধরণের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে শিখন স্কুল, শিখন ক্লাব ও শিখন কেন্দ্র। শিখন স্কুলে একটি নির্দিষ্ট কারিকুলাম অনুযায়ী লেখাপড়া হচ্ছে। শিখন ক্লাবে তৃতীয় শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত দুর্বল ২০জন শিশুকে নিয়ে স্কুল পরবর্তী সময়ে বাংলা, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে ২৪টি লেখাধুলার মাধ্যমে শেখানো হয়। শিখন কেন্দ্রে রয়েছে ৫ বছর থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের নিয়ে ৩ বছর মেয়াদী প্রারম্ভিক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম।
কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার ১৩টি উপজেলায় ৬৬৯টি শিখন স্কুল, ১৭১টি শিখন ক্লাব ও ৪১০টি শিখন কেন্দ্র বাস্তবায়ন করছে কোডেক। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এ প্রকল্প চলবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত।
শিখন-কোডেক প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর রতন চক্রবর্তী বাংলানিউজকে বলেন, ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোর সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে শিক্ষা ও সাক্ষরতার হার কম। এই বিবেচনায় এই অঞ্চলের শিশুদেরকে স্কুলমুখী করতে এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কার্যক্রমের ফলে এরইমধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যেসব শিশুরা স্কুলে যেত না, তারা স্কুলে এসে মানসম্মত শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ পাচ্ছে। পাড়ায় পরিবারগুলোর মধ্যে আন্ত:সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়েছে।
পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবরটি বাংলানিউজে দেখতে চান? মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]
বাংলাদেশ সময় ০১৩৬ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৪