ঢাকা, সোমবার, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৯ জুন ২০২৫, ১২ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

উপকূল থেকে উপকূল

যেখানে নৌকায় রাস্তা পারপার!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০:৩২, জুলাই ১৭, ২০১৪
যেখানে নৌকায় রাস্তা পারপার! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খাউলিয়া, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট ঘুরে এসে: নদী নয়, এখানে রাস্তা পারাপার হতে হয় নৌকায়। নদীর তীরের প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা ভেঙ্গে হাজারো মানুষের ভোগান্তি ডেকে এনেছে।

এলাকার মানুষের কাছে এ ভোগান্তির চিত্র অনেকটা গা সওয়া হলেও প্রথম দেখায় যে কেউ থমকে দাঁড়াবেন। রাস্তা পারাপারের জন্য নৌকার অপেক্ষা যাত্রীদের!

নৌকায় রাস্তা পারাপারের এ অভিনব দৃশ্যটি বাংলানিউজের চোখে পড়ে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে সন্যাসী যাওয়ার পথে। মোরেলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের গাবতলায় এসে থেমে যায় ভ্যান। রাস্তার ভেঙ্গে যাওয়া প্রান্তে পারাপারের জন্য অপেক্ষা বহু যাত্রীর। ইঞ্জিনচালিত নৌকা আসছে-যাচ্ছে। ১০-১৫ জন যাত্রী হলেই রুটিন মেনে ছেড়ে যায় নৌকাগুলো। বেশিরভাগ যাত্রীর গন্তব্য খাউলিয়া, সন্যাসী।

ভাঙ্গা রাস্তা পেরিয়ে ঠিক ওপারেই এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার তালুকদারের বাড়ি। যতোবারই মোরেলগঞ্জে যান, এই নৌকা পার হতে হয়। বাংলানিউজের পরিচয় পেয়ে এলাকার মানুষের ভোগান্তির বিবরণ তুলে ধরেন তিনি। বললেন, এমন একটা দেশে আছি, রাস্তা পার হতে হয় নৌকায়। ভেঙে যাওয়ার পর নতুন রাস্তা তৈরির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এলাকাটি মোরেলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের গাবতলা গ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পানগুছি নদী। আর এ নদীর তীর ধরেই চলে গেছে পিচঢালা আবার কোথাও ইট বিছানো রাস্তা। এ পথে পার্শ্ববর্তী উপজেলা শরণখোলা যাওয়া যায়। এক সময় ঢাকাগামী বাসও চলতো এই পথে।

অন্যদিকে ঢাকা থেকে আসা স্টিমার ভেড়ে সন্যাসী বাজারের কাছে। এসব কারণে এ সড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও নতুন রাস্তা নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেই।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, পানগুছি নদীটি এখানে দিনে দিনে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। বহু বাড়ি-ঘর, জনপদ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বহু মানুষকে নি:স্ব করেছে। অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। অন্তত ৫০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত এ ভাঙনে। বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে অবশেষে কয়েক বছর ধরে এই রাস্তা ভেঙ্গে গেছে নদীতে। ভাঙন এখনও থামেনি। বর্ষায় ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে।

রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়ার পর মানুষজন নদীর তীর ধরে ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে কাদাপানি ভেঙ্গে চলাচল করেন। পরে পারপারের জন্য চালু হয় নৌকা। একবার পার হতে ভাড়া দিতে হয় ৫ টাকা। অনেকের আবার এ ভাড়া নিয়েও আপত্তি আছে। ভাড়াটা কম হলে মানুষ সহজে চলাচল করতে পারেন।
 
ভাঙন পেরিয়ে ওপারে উঠেই খাউলিয়া বাজার। এখানে কথা হলো অনেকের সঙ্গে। একজন কবির গাজী। খাউলিয়া ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। পানগুছির তীরে বাড়ি ছিল তার। অন্তত দশ বছর আগে বাড়ি-ঘর হারিয়ে খুলনা শহরে চলে গেছেন। এক সময় নিজের জমিতে চাষাবাদ করেই জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন তিনি গাড়ির হেলপার। ভাঙনের কারণে তার আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।

আরেকজন আবদুস সাত্তার শেখ। বাড়ি ছিল একই স্থানে। এখন ছোট্ট দোকান দিয়েছেন খাউলিয়া বাজারে। ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডে থাকা বাড়িটি ভেঙ্গে যাওয়ার পর এক নম্বর ওয়ার্ডে একখণ্ড জমি কিনে ক্ষুদ্র ব্যবসায় জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করছেন। অথচ এক সময় তার প্রায় তিন বিঘা জমি ছিল। সবই গিলেছে পানগুছি নদী।
 
পানগুছি পাড়ের মানুষেরা বর্ষার ছ’মাস অনেক কষ্টে জীবন কাটান। কাজকর্ম থাকে না। ঘর ডুবে থাকে পানিতে। বিশেষ করে খাউলিয়া বাজার থেকে সন্যাসী যাওয়ার পথে পানগুছির তীরে বাঁধ না থাকায় স্বাভাবিক জোয়ারেও পানি ঢুকে পড়ে বাড়ি-ঘরে। জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়ায় পশুরবুনিয়া গ্রামের মৃত আবদুল হামিদের স্ত্রী বরুজান বিবি ঘর থেকে বের হতে পারছিলেন না। বললেন, বেশি পানি বাড়লে রাস্তায় উঠি।
সন্যাসী বাজারের কাছে খাউলিয়া ইউনিয়ন পরিষদে আলাপ হলো স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে। তারা জানালেন, পানি এলাকার বড় সমস্যা। একদিকে বেড়িবাঁধ নেই, অন্যদিকে খাউলিয়া বাজারের কাছে রাস্তা ভেঙ্গে গেছে। জোয়ার এলে বহু গ্রাম পানিতে ডুবে যায়।

এ ইউনিয়নের পশুরবুনিয়া, চালিতাবুনিয়া, মিশানবাড়িয়া আর খাউলিয়া গ্রামের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়। মাত্র ৩-৪ দিন আগে বয়ে যাওয়া পূর্ণিমার জোয়ার এলাকা ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। এখনও অনেক স্থানে পানি জমে আছে।

খাউলিয়া ইউপির সাবেক মেম্বার আবদুল কাদের মাল, ইউনিয়নের বাসিন্দা রুহুল আমীন শেখ, আবদুস সালাম খান, কামাল শেখসহ আরও অনেককে জানালেন, খাউলিয়া ইউনিয়নের সন্যাসী বাজার থেকে মোরেলগঞ্জ সদর পর্যন্ত বেড়িবাঁধ নেই। এখানে আছে এলজিইডির ৬ ফুট উঁচু রাস্তা। বাঁধ না হলেও এই রাস্তাটি অন্তত দশ ফুট উঁচু করা হলে পানি রোধ করা সম্ভব।

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ- উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।