রংপুর: বাংলাদেশের কৃষকদের চাষাবাদে ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী কাঠের হাতল ও লোহার ফাল বিশিষ্ট কাঠের লাঙ্গল আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
বর্তমানে কৃষকরা জমিতে লাঙ্গলের পরিবর্তে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর ব্যবহার করছেন।
কৃষকরা জানান, এক সময় চাষাবাদের অন্যতম উপকরণ ছিল কাঠের লাঙ্গল। লাঙ্গল ছাড়া চাষাবাদের কথা চিন্তাই করা যেত না।
কিন্তু আধুনিক যুগে চাষাবাদের যান্ত্রিক সব উপকরণ এসেছে। এ সকল যান্ত্রিক উপকরণ দিয়ে জমিতে চাষ দিলে সময় কম লাগে। তারা জানান, সময় কম লাগলেও খরচ পড়ে বেশি। লাঙ্গল, জোয়াল, মই মেরামত করতে হয় না। এগুলো একবার বানালে তা দীর্ঘদিন চলে।
তবে এখনও লাঙ্গল, জোয়াল, মই ব্যবহার করছেন অনেক কৃষক। গ্রাম-এলাকার হাটবাজারে এখনও বিক্রি করা হয় লাঙ্গল, জোয়াল, মই।
কৃষকরা এ সকল সরঞ্জামের পসরা সাজিয়ে বসে থাকেন বিক্রির আশায়। কিন্তু আগের মতো চাহিদা না থাকায় ধীরে ধীরে পেশা পরিবর্তন করছেন কৃষকরা।
জেলার কাউনিয়া উপজেলার, রংপুর কাউনিয়া টেপামধুপুরের জিগাবাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, যারা এখনো এটিকে পেশা হিসেবে ধরে রেখেছেন তারাও চলছেন ধুঁকে ধুঁকে।
লাঙ্গল তৈরির কারিগর আব্দুল হাই জানান, এক সময় তার সচ্ছল সংসার ছিল। লাঙ্গল তৈরি করে যা উপার্জন করতেন, তাই দিয়ে চলতো পরিবার। ওই সময় গ্রাম-গঞ্জে লাঙ্গল দিয়ে চাষাবাদ করা হতো। তাই লাঙ্গলের চাহিদাও ছিল প্রচুর। সংসারে এসেছিল সুখ। প্রতিদিন ২০/২৪টি লাঙ্গল তৈরি করতেন তিনি। এগুলো বিক্রি হতো রংপুরের লালবাগহাট, শ্যামপুর, পার্বতীপুর, বদরগঞ্জ, পাওটানা, মীরবাগ, কাউনিয়া, তিস্তা, পীরগাছা, আন্নদনগরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন হাট-বাজারে।
আব্দুল হাই জানান, বর্তমানে এখন গ্রামাঞ্চলে গরু দিয়ে জমি চাষ করা হয় না। তাই এ পেশাকে অনেকেই পরিবর্তন করেছেন।
সাধারণত আশ্বিন থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত লাঙ্গলের চাহিদা থাকে। এ সময়ে লাঙ্গল তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন ব্যবসা করে জীবিকা অর্জন করেন লাঙ্গলের কারিগররা।
তবে আব্দুল হাই বলেন, বাকি সময় কাজ থাকে না। তাই ঋণ করে সংসার চলাতে হয়।
তিনি আরও বলেন, গাছের বিভিন্ন গুল বা গুঁড়ি ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত তারা কেনেন। এ গুল হাতের শৈল্পিক ছোঁড়ায় লাঙ্গলে রূপ দেওয়া হয়। যা বাজারে ২৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
৮০ বছর বয়সী আবুল হোসেন বলেন, আমার হাত ধরে কমপক্ষে ৩০০ জন এ কাজ শিখেছেন। তারা এখন অনেক উন্নতি করেছেন। লাঙ্গলের চাহিদা না থাকায় অনেকে আবার আসবাব পত্র তৈরির পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।
বর্তমানে লাঙ্গলের চাহিদা না থাকায় এক প্রকার বেকার জীবনযাপন করছেন আবুল হোসেনও। স্বাধীনতার পরপরই এ ব্যবসা শুরু করেন তিনি। তখন পায়ে হেঁটে বিভিন্ন হাট-বাজারে গিয়ে লাঙ্গল বিক্রি করেছেন। এসব শুধু এখন তার কাছে স্মৃতি।
তিনি লাঙ্গল প্রস্তুতকারকদের এই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কামনা করেন।
কাঠের লাঙ্গল যেন আজ ঐতিহ্য বহন করা আর স্মৃতি জাগানিয়া শুধুই কালের সাক্ষী। এক সময় এটার হয়তো স্থান হবে মিউজিয়ামে।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০১৪