‘মানচিত্র, সীমারেখা- একবিশ্বে বিভক্ত পৃথিবী/ কবি তার অংশ নয়-/তার নাম চিরমুক্ত পাখি/জন্ম যদি চুরুলিয়া মৃত্যু তবে ঢাকার মাটিতে/কবিকে রুখতে পারে এরকম কাঁটাতার নেই। ’- কবিতার এরকম উজ্জ্বল পঙক্তি নিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি কবি কাজী নজরুল ইসলামের চুরুলিয়া গ্রাম থেকে সাইকেলে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন দুজন সাইকেল আরোহী জয়নাথ নন্দী ও দেবাশীষ ভট্টাচার্য।
জয়নাথ পেশায় দলিল লেখক। অফিস বর্ধমান জেলার রাণীগঞ্জে। পেশা যা-ই হোক, তার নেশা পাহাড় টপকানো। দিগন্ত-রেখায় ঝাড়খর পাহাড়চূড়াগুলো তাকে টেনেছে আশৈশব। তিনি পরিবেশবাদী ও পর্বতারোহী সংগঠন ‘কোল্ডফিল্ড নেচার লাভারস’-এর যুগ্ম সম্পাদক। অন্যদিকে, দেবাশীষও দলিল লেখক। চাকরি করেন একই অফিসে। তবে তার নেশা কবিতায়, সাহিত্যে। তিনি ‘চিরঞ্জীব’ নামের একটি ছোটকাগজের সম্পাদক। তাই বাংলাভাষার সব কবিই আর আত্মীয়।
কাজী নজরুল ইসলাম চিরনিদ্রায় শায়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে। অপরদিকে কবিপত্নী প্রমীলা কাজী ভারতের চুরুলিয়ায়। দুজন দুই দেশে। কিন্তু কীভাবে সম্ভব এ মিলন ঘটানো, এ তো অসম্ভব? কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি তীব্র ভালোবাসা আর আবেগ নিয়ে এ অসম্ভবকেই যেন সম্ভব করা হলো ২৮ ফেব্রুয়ারি কবির কবরে প্রমীলা কাজীর কবরের মাটি ছড়িয়ে দিয়ে।
২৮ ফেব্রুয়ারি ৩টা। দুপুরের রোদ ছুঁয়ে ফেলেছে বিকেলের নীরবতা। কাছেই হঠাৎ হঠাৎ কোকিল ডাকছে। এর মধ্যে কবির কবরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার, নজরুল-গবেষক রফিকুল ইসলাম, কবির নাতনি খিলখিল কাজী, চুরুলিয়ার সাইকেলপরিব্রাজক জয়নাথ নন্দী ও দেবাশীষ ভট্টাচার্যসহ অনেক নজরুল অনুরাগী।
ফটোসাংবাদিকরা ছবি তুলছেন একের পর এক আর এরই মধ্যে কবির নাতনী খিলখিল কাজীসহ সকলেই বাক্স থেকে প্রমীলার কবরের মাটি মুঠোতে নিয়ে ছড়িয়ে দেন কবির কবরে। আর প্রমীলার কবরের জন্য মুঠোভর্তি করে মাটি তুলে দেওয়া হয় কবির কবরের মাটি।
মাটি বিনিময় শেষে, খিল খিল কাজী বলেন ‘আমার মনে হয় প্রমীলা কাজীর কবরের মাটি এখানে স্থাপনের মধ্য দিয়ে আজ দুজনের পুনরায় মিলন হলো’।
দেবাশীষ ভট্টাচার্য বলেন ‘আমরা নজরুল-সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছি। নজরুলের প্রতি আমরা দায়বদ্ধ। বাংলাদেশের সব গুণীজনকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমাদের প্রাণের কবিকে, আমাদের ঘরের কবিকে আপনারা জাতীয় কবি হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তার জন্য আমি গর্বিত। ’
তিনি আরও বলেন, চুরুলিয়ার প্রতি আমাদের ঋণবোধ থেকে আমরাও স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশের মানুষ যাতে আরও এগিয়ে যান। বাংলাদেশের আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ। ’
ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন ‘একটি দেশের সাথে আরেকটি দেশের সম্পর্ক থাকে। কিন্তু সেই সম্পর্ক ছাপিয়ে যায় তখন, যখন সব কিছুর ঊর্ধ্বে কোনো কিছু জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনা এরকমই একটি ঘটনা। ’
বাংলাদেশ সময় ২২১৩, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১১