ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২২ মে ২০২৫, ২৪ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

পল্টন বইবাজারের কথা

ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:২৮, এপ্রিল ২০, ২০১১
পল্টন বইবাজারের কথা

আশির দশকের শুরু থেকেই ঢাকার পল্টন ফুটপাতে গড়ে উঠেছে পুরোনো বইয়ের বাজার। এই বাজার চলে সকাল দশটা থেকে প্রায় রাত নয়টা-দশটা পর্যন্ত।

প্রতিদিনই এখানে আসে নানা শ্রেনীর পাঠক বই কিনতে। পাওয়া যায় কম দামে দেশি বিদেশী শিল্পসাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, খেলাধুলা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যলয়ের পাঠ্যবইসহ নানা ধরণের বই। পাওয়া যায় অনেক পুরোনো দুর্লভ বইও, যা বইপ্রেমী পাঠকদের সংগ্রহকে করে সমৃদ্ধ।

প্রথমদিকে মাত্র চার-পাঁচটি দোকান নিয়ে এই বাজারের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এখানে রয়েছে প্রায় ৩০টির মত বইয়ের দোকান। কারা প্রথম এই বাজার শুরু করেছিল জানতে চাইলে, মোহাম্মদ সুজন নামের এক বিক্রেতা জানান ‘এই মার্কেটের বয়স প্রায় ৩০ বছর। সম্ভবত আশি সালের প্রথম দিকে হাদী, আব্দুল, উত্তম, সালাম, হাসেমসহ অল্প কয়েজন মিলে এই বাজার চালু করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গেছে, কেউ আবার এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে। বর্তমানে এখানে প্রায় ত্রিশটির মতো বইয়ের দোকান আছে। ’

যেভাবে এই ব্যবসার সাথে

জীবিকার প্রয়োজনে মানুষকে করতে হয় বিচিত্র ধরণের কাজ। এই পুরোনো বইয়ের বাজারকে কেন্দ্র করেও গড়ে উঠেছে একদল লোকের জীবন-জীবিকা। এখানকার বইবিক্রির আয় দিয়েই চলে তাদের সংসার। এই ব্যবসার সাথে কেউ জড়িয়ে পড়েছে পৈতৃক সূত্রে; কেউ বা এখানে ছোটবেলা থেকে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করে, পরে নিজেই কাজ শিখে বইয়ের দোকান দিয়ে বসেছে; কেউ আবার জীবিকার জন্য কাজ খুঁজতে গিয়ে কারও পরামর্শে এটাকে সম্মানজনক পেশা বিবেচনা করে জড়িয়ে পড়ে। এখানকার বইবিক্রেতাদের রয়েছে নিজস্ব পুস্তক সমিতি।

পেশা হিসেবে এখানে বইবিক্রির সাথে জড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে মাঝ বয়সি বাবুল বলেন ‘আমি বই বিক্রি করছি ১৯৯১ সাল থেকে। আমি কাজ খুঁজছিলাম ঢাকাতে, আমার এক বন্ধু তখন আমাকে এই ব্যবসার কথা বলে, কিভাবে এই ব্যবসা করতে হয় তাও জানিয়ে দেয়। ওনার পরামর্শেই আমি পুরনো বই বিক্রির সাথে জড়িয়ে পড়ি। এই ব্যবসাই আমাকে এখন পেটে ভাত দেয়। ’

২৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ সুজন বলেন ‘২০০১ সাল থেকে আমি এখানে দোকান দিছি। আমার বাবার পুরোনো বইয়ের দোকান ছিল। আমার কাকা হাদী সাহেবেরও পুরোনো বইয়ের দোকান ছিল। ছোটবেলা থেকে আমি কেবল পুরোনো বই বিক্রির কাজই শিখছি। ফলে অন্য কোনো দিকে না গিয়ে আমি এই ব্যবসার সাথে থেকে গেছি। ’

৩০ বছর বয়সী চাঁদপুরের হাসান বলেন ‘আমি হইলাম এই মার্কেটের অনেক পুরান লোক। ২২ বছর  আমি এই মার্কেটে আছি। ৮ বছর বয়সে আমার এক চাচা চাঁদপুর থেকে আমার ওস্তাদ শাহাবুদ্দিন সাহেবের কাছে দিয়ে যায়। আমি পাঁচ বছর তার সাথে কাজ করছি, তার কাছ থেকেই আমি সব কাজ শিখছি।   আমার ওস্তাদ এখন আর এই ব্যবসা করে না। ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে আমি নিজেই একটা বইয়ের দোকান দিছি। অনেক কম বয়সেই আমি বিয়ে করেছি। আমার দুই ছেলে। একটার বয়স দশ, আরেকটার আট। এই বইবিক্রির টাকা দিয়েই আমি আমার দুই ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াইতেছি। ’

পল্টন বইবাজারে যারা দোকান দিয়ে বসেছে তাদের প্রায় সবারই ঘর-সংসার নির্ভর করে আছে পুরনো বই বিক্রির ওপর। কোনো কোনো দিন ভাগ্য ভালো থাকলে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বিক্রি হয়, আবার  কোনো দিন থাকে মন্দা। বৃষ্টির দিন, হরতাল কিংবা রোজার মাসে বই বিক্রি থাকে খুবই মন্দা। এইসময়গুলিতে তাদের বেশ কষ্ট করেই চলতে হয়।

যেভাবে আসে পুরনো বই

ক্রেতাদের চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে বিক্রেতাদের প্রতিনিয়তই আনতে হয় নতুন নতুন পুরোনো বই। বইগুলি বেশিরভাগই আসে নিমতলি, চাংখারপুল, সদরঘাট, শহরের নানান ভাংগারি বা বিভিন্ন কাগজের দোকান থেকে। বিক্রেতাদের এই বইগুলি সংগ্রহের রয়েছে নানা মাধ্যম। এইগুলি তিন-চার হাত ঘুরে পরে এক-এক লটে আসে এখানে। প্রতি লটে থাকে প্রায় হাজার খানেক বই। এক-একটা লট আসলে সকল বিক্রেতারা একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে বই ভাগ করে নেয়।
 
কখনও কখনও তারা আবার ব্যক্তিগত যোগাযোগ থেকে পুরোনো বই বিক্রিতে আগ্রহী বিভিন্ন লাইব্রেরি বা বিদেশে চলে যাওয়া পরিবারের কাছ থেকেও বই সংগ্রহ করে থাকে।

অন্যান্য প্রসঙ্গ

পল্টন ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে গেলে প্রতিদিন বিকেলে বা সন্ধ্যায় দেখা যায় বইয়ের দোকানগুলোর সামনে অসংখ্য লোকের ভীড়। এখানে সাধারনত কোন্ শ্রেণীর লোক আসে কিংবা কোন্ ধরণের বই বেশি চলে জানতে চাইলে বিক্রেতারা জানানÑ এখানে ছাত্র, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, তরুণ-প্রবীন লেখক কবি-সাহিত্যিক, আর্টিস্ট, নাট্য-ব্যক্তিত্বসহ বিচিত্র ধরনের লোকই আসে। পাশেই রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির অফিস, ফলে অনেক রাজনৈতিক কর্মীরাও আসেন। বিশিষ্ট যে সব ব্যক্তিদের সাধারনত দেখা যায়, তাদের মধ্যে রয়েছেন- অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, কবি বেলাল চৌধুরী, শিশুসাহিত্যিক শাহরিয়ার কবির, অভিনেতা শঙ্কর শাহজালাল ও সাদেক বাচ্চু প্রমুখ।

এখানে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই বেশি চলে, এছাড়া হুমায়ূন আহমেদ ও সেবা প্রকাশনীর বইসহ বিভিন্ন সাহিত্যের বই, অনুবাদের বই, ধর্মীয় ও ইতিহাসভিত্তিক বই বেশি চলে। তবে এখানে যে কোনো ধরনের সৃজনশীল ও মননশীল বইয়েরই বিক্রি খুব ভালো।

সম্প্রতি ক্রেতাদের মুখে একটা অভিযোগ শোনা যায়, পুরনো বইয়ের দামও বেড়ে গেছে। দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বিক্রেতারা বলেনÑ সম্প্রতি সমস্ত কিছুর খরচ বেড়ে গেছে, তাদেরকে অনেক বেশি দামে বই কিনতে হয়, তাছাড়া বই আনতে গিয়ে পরিবহন ব্যয়ও হয় অনেক। এই সমস্ত কারনে পুরোনো বইয়ের দাম সম্প্রতি বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ সময় : ১৮৩০, ২১এপ্রিল ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।