ঢাকা: পুষ্পা আর নিলয়ের সম্পর্ক অনেক দিনের। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ে তারা।
কিন্তু বেশকিছু দিন ধরেই পুষ্পার মন ভালো নেই। কেমন যেন একটা অস্তিত্বহীনতায় ভুগছে সে। কারণটা হলো, ফেসবুকে নিলয়ের নতুন এক বন্ধু হয়েছে। নাম প্রভা।
নিলয় প্রায়ই তার সঙ্গে চ্যাট করছে। ফোন আর ভাইবারেও কথা হচ্ছে তাদের। বিষয়টি নিলয় পুষ্পাকে জানিয়েছেও। প্রভার সঙ্গে এই পরিচয়কে নিলয় নিছক বন্ধুত্ব হিসেবেই ধরে নিতে চায়। কিন্তু পুষ্পা? সেও প্রভাকে নিলয়ের ভালো বন্ধুই ভাবতে চায়। তবে তার প্রায়ই মনে হয়, প্রভার সঙ্গে বন্ধুত্বের পর নিলয় পুষ্পার কাছ থেকে একটু হলেও দূরে সরে গেছে। পুষ্পার জন্য নিলয়ের সময়টাও যেন ভাগ করে নিতে হচ্ছে প্রভার সঙ্গে।
পুষ্পার কেন যেন মনে হয়, নিলয় পুষ্পাকে অবজ্ঞা করছে, এড়িয়ে চলছে। পুষ্পা ভাবে, প্রভা কি পুষ্পার চাইতেও ভালো দেখতে আর স্মার্ট! নিলয় পুষ্পাকে ভুলে যাবে না তো! নিলয় কি পুষ্পার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে! যদি সরে যায় তাহলে কী হবে!
ইদানিং এ প্রশ্নগুলো প্রতিনিয়তই ভাবায় পুষ্পাকে। কেমন একটা ভয় হয় তার। হয়তো নিলয় তাকে ভুলেই যাবে একদিন।
আপনারও কি রয়েছে এমন কোনো অনুভূতি? এই ধরুন, আপনার কাছের কোনো মানুষ, হতে পারে পরিবার বা বন্ধুদের কেউ আপনাকে অবজ্ঞা করছে বা আপনার মনে হচ্ছে, নতুন কারও আগমনে তিনি আপনাকে পরিত্যাগ করতে পারে বা ভুলে যেতে পারেন। আর এই ভাবনাগুলো আপনাকে ধীরে ধীরে বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে! যদি তাই হয়, তাহলে বলা যেতে পারে আপনি আথাজাগোরেফোবিয়াতে আক্রান্ত।
আথাজাগোরেফোবিয়া কী
আথাজাগোরেফোবিয়া বা কারও মন থেকে হারিয়ে যাওয়ার ভয় এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি, যার ফলাফল অনেক ক্ষেত্রে খুব বিপজ্জনক। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ধারণা, যারা তাকে একসময় অনেক মূল্যায়ন করতেন, তারা নতুন কারও আগমনে তাকে অবহেলা করছেন বা ভুলে যাচ্ছেন। এ সমস্যাটি ব্যক্তির মনে রাগ, ক্ষোভ ও বিষণ্ণতার জন্ম দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেই জানেন যে, তার এ আশঙ্কা ঠিক নাও হতে পারে। তবুও তারা ভয় পান ও নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।
ফলাফল
আথাজাগোরেফোবিয়ার ফলস্বরূপ একজন ব্যক্তি নানামুখী আচরণ করতে পারেন। প্রিয় মানুষ তাকে ভুলে যাচ্ছে বা অবহেলা করছে, এই দুশ্চিন্তা তার মধ্যে একাকীত্ববোধ সৃষ্টি করে। ফলে তিনি নিজেকে অযোগ্য মনে করতে শুরু করেন ও সবার কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন।
আবার অনেকে এ অনিরাপত্তাবোধ থেকে মুক্তি পেতে যেকোনো কিছু করার জন্য প্রস্তুত থাকেন। এক্ষেত্রে অনেকে কথা কাটাকাটি, রাগারাগি, বলপ্রয়োগ, হিংস্র পদক্ষেপ ছাড়াও আত্মহত্যার চেষ্টাও করতে পারেন। সাধারণত আথাজাগোরেফোবিয়াতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের এক পর্যায়ে নিজের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
আগেই বলেছি, এ ফোবিয়ায় আক্রান্তরা সবাই জানেন যে, তাদের ভাবনার বেশিরভাগই অমূলক, তবে যখন তারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন অর্থাৎ কল্পনায় যখন ভাবেন, প্রিয় মানুষটি ভুলে গেলে তাদের কী অবস্থা হবে, তখনই মূলত নিজেদের সামলাতে পারেন না।
কারণ
একটা কথা জেনে রাখা ভালো, শুধু আপনিই নন সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রায় অনেকেই এ ফোবিয়ায় আক্রান্ত। অতীত অভিজ্ঞতা ছাড়াও যেকোনো কিছু নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করা, তীব্র বিশ্বাস ও ভালোবাসা, সঙ্কীর্ণ গণ্ডি এবং নিজেকে ছোট ভাবা এর প্রধান কারণ। অনেক সময় এটি জন্মগতভাবেই আসে।
লক্ষ্মণ
পৃথিবীতে কেউই নিজেকে ভুলে যাবার পাত্র-পাত্রী হতে দিতে চান না। এটাই স্বাভাবিক। সবাই তার প্রিয় মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই থাকতে চান। অনেকেই আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ দিয়ে নিরাপত্তাহীনতার এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারেন।
তবে অনেককেই ভোগায় আথাজাগোরেফোবিয়ার ভয়াবহ ফলাফল। কোনো ব্যক্তি আথাজাগোরেফোবিয়ায় আক্রান্ত তা কেবল মাত্র তার আচরণ দিয়ে বোঝা সম্ভব। এ ফোবিয়া বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি তার দক্ষতা, মানসিক ভারসাম্য ও আত্মমর্যাদা হারাতে শুরু করেন।
আথাজাগোরেফোবিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষ্মণগুলো এক একজনের অনুভূতির গভীরতার উপর নির্ভর করে। তবে সাধারণ লক্ষ্মণগুলোর মধ্যে অনিদ্রা, খাওয়ায় অরুচি, কাজে অনীহা, কান্নার প্রবণতা, দ্রুত রেগে যাওয়া, যার দ্বারা অবহেলিত ও যার কারণে নিজেকে অবহেলিত মনে হচ্ছে, তাদের অবয়ব ও উপস্থিতি সহ্য করতে না পারা ইত্যাদি।
সুরক্ষা
আপনার মধ্যে যদি এ লক্ষ্মণগুলো দেখা যায় তাহলে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। এছাড়াও আপনাকে নিতে হবে ব্যক্তিগত কিছু পদক্ষেপ। কারণ, এ ফোবিয়া আপনাকে বাইরের জগৎ থেকে খানিকটা ভেতরের দিকে অর্থাৎ আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। আর সেই ব্যাপারটিকেই ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। যদি তা না হয়, তাহলে আথাজাগোরেফোবিয়া নেবে আরও ভয়াবহ রূপ।
নিজেকে জীবন-জগতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করুন। সংগঠনমূলক কাজ করুন। যেখানে একটি টিমে আপনাকে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশলে নিজেকে আর নিজের গুণগুলোকে উপলব্ধি করতে পারবেন। আমরা অনেক সময় অন্যের মাধ্যমেও নিজেদের পছন্দের ক্ষেত্রগুলোকে বাছাই করতে পারি। নিজেকে ব্যক্তি কেন্দ্রিক করে গড়ে তুলবেন না।
ভালোবাসুন তবে নিজের সুখের চাবিকাঠি কারও হাতে তুলে দেওয়া আপনার জন্যই ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে। নিজের আনন্দের বহুমুখী উৎস সৃষ্টি করুন। মাঝে মাঝে নিজের কাজে একাই বাইরে যান। কাজ শেষ করুন নিজের হাতেই। এতে পরনির্ভরশীলতা দূর হয়ে স্বনির্ভরতা তৈরি হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, জীবনকে ধরে বেঁধে রাখবেন না। সবারই নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার রয়েছে। সৎভাবে আপনি যেকোনো কিছুই করতে পারেন। নিজের বন্ধুত্বের পরিসর বাড়ান। আর আগের চাইতে নিজেকে অনেক বেশি ভালোবাসুন।
বাংলাদেশ সময়: ০১৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৫