নাটোর: স্বাদে অতুলনীয় মিষ্টান্ন ‘নাটোরের কাঁচাগোল্লা’। নামে কাঁচাগোল্লা হলেও এ মিষ্টান্ন কিন্তু কাঁচা নয়, আবার দেখতে গোলও নয়।
কাঁচাগোল্লা তৈরির সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন, সেসব কারিগরদের উত্তরসূরিদের বেশিরভাগই ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর ভারতে চলে যান। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। সর্বোপরি কাঁচাগোল্লা নিয়ে কোনো গবেষণার কথাও শোনা যায় না। তাই কাঁচাগোল্লার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা দূরহ ব্যাপার।
কাঁচাগোল্লা তৈরি শুরু হয় ঠিক কবে তা নিয়ে খোদ নাটোর শহরেই ভিন্ন ভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে। শহরের শুকুলপট্টি এলাকার লোকজনদের মধ্যে জনশ্রুতি রয়েছে, নাটোরের রাজস্ট্যাটের বড় তরফের নাজা গোবিন্দ্রনাথের স্ত্রী ব্রজসুন্দরীর দত্তকপুত্র মহারাজা জগদ্রিন্দ্রনাথ নাথ রায় একটু খেয়ালী প্রকৃতির ছিলেন।
একদিন গভীর রাতে মিষ্টি খাওয়ার বায়না ধরেন তিনি। ডাকা হল রাজ কারিগরকে। কিন্ত এত রাতে কোথায় পাওয়া যাবে মিষ্টি? কিভাবেই বা মিষ্টি তৈরি হবে? হঠাৎ কারিগর গাভি দুইয়ে দুধ সংগ্রহ করে সেই দুধ উনুনে জ্বাল দিয়ে ছানা তৈরি করে তাতে চিনি মিশিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে সুস্বাদু মিষ্টি তৈরি করে মহারাজাকে খেতে দিলেন।
মহারাজা খেয়ে খুব খুশি। এমন স্বাদের মিষ্টির নাম জানতে চাইলেন তিনি কারিগরের কাছে, কারিগর কোন কিছু চিন্তা-ভাবনা না করেই বললেন ‘কাঁচাগোল্লা’।
অন্য এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, নিতান্ত দায়ে পড়েই তৈরি হয়েছিল এই মিষ্টি। শহরের নিচাবাজারে মধুসূদন দাস নামে এক ব্যক্তির দোকান ছিল। নাটোরের প্রসিদ্ধ এ মিষ্টির দোকান থেকে প্রতিদিন ট্রেনে করে ৪০/৫০ টিন বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি কোলকাতায় যেত। মিষ্টির টিনের গায়ে লেখ থাকত মধুসূদন দাস।
মধুসূদন দাসের দোকানে বেশ কয়েকটি বড় বড় চুলা ছিল। দোকানে দশ পনের জন দক্ষ কারিগর কাজ করতেন। একদিন মিষ্টির দোকানের বেশিরভাগ কারিগর আসেনি। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানাতে চিনি ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখা হয়। দেখা যায়, চিনিমেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। নতুন মিষ্টান্নর নাম দেওয়া হলো কাঁচাগোল্লা।
শহরের রানীভবানী প্রতিষ্ঠিত জয়কালী মন্দির সংলগ্ন দ্বারকানাথ কুন্ডু মিষ্টির দোকানে ১৬০ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে কাঁচাগেল্লাসহ অন্যান্য মিষ্টি তৈরি হয়ে আসছে। বড়গাছা এলাকার দ্বারিকা নাথ কুন্ডু একই সঙ্গে ছিলেন কারিগর ও দোকানের মালিক। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে ননীগোপাল কুন্ডু দোকানের হাল ধরেন। তিনি মারা গেলে বর্তমানে তার ছেলে রবীন্দ্রনাথ কুন্ডু সুনামের সঙ্গে কাঁচাগোল্লা তৈরি ও বিক্রি করছেন।
বর্তমানে নিচাবাজার কুন্ডুর দোকান, জয়কালি মিষ্টির দোকান, মৌচাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারসহ বেশ কিছু দোকানে মানসম্মত কাঁচাগোল্লা পাওয়া যায়। প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে প্রতিকেজি কাঁচাগোল্লার দাম পড়বে ৪/৫শ’ টাকা।
কারিগর রবী কুন্ডু, অরুন পাল জানান, খাঁটি দুধের ছানা ও চিনি কাঁচাগোল্লা তৈরির প্রধান উপাদান। ১ কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে প্রায় ১ কেজি কাঁচা ছানা লাগে। এই ছানা হতে হবে ননি ও সর না তোলা দুধের। ৪০০ গ্রাম চিনি কড়াইতে নিয়ে পরিমাণমত পানিসহ জ্বাল দিতে হয়। এ সময় কাঠের খন্তা দিয়ে নাড়তে হয়। এভাবে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ধারাবাহিকভাবে নাড়তে নাড়তেই কাঁচাগোল্লা তৈরি হয়ে যায়।
বর্তমানে প্রতিকেজি কাঁচাগোল্লা ৩২০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শীতের মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর দর্শনার্থী পর্যটক নাটোরের জয়কালীবাড়ি, উত্তরা গণভবন, নাটোর রানীভবানী রাজবাড়িতে ভ্রমণে আসেন। এ সময় কাঁচাগোল্লা বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এছাড়া, ঈদের আগে বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যায়।
নাটোরের বাস টার্মিনাল ও রেল স্টেশনে হকাররা যে কাঁচাগোল্লা বিক্রি করেন, তা আসল কাঁচাগোল্লা নয়। যাত্রীরা প্রকৃত কাঁচাগোল্লা সম্পর্কে না জানার সুবাদে এ প্রতারণার আশ্রয় নেয় হকাররা। তাই আসল কাঁচাগোল্লার স্বাদ পেতে শহরের ভেতরের দোকান থেকে কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৯ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০১৫
এমজেড