ছায়া ঢাকা গ্রাম সুবিদপুর। পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার চার নম্বর চিড়াপাড়া ইউনিয়নের এই গ্রামে নিরবে ঘটেছিল শিল্প বিপ্লব।
যেভাবে শুরু
জনশ্রুতি আছে পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার সুবিদপুরে একসময় পাইত্রা নামের একধরনের উদ্ভিদ জন্মাতো। ওই পাইত্রা রোদে শুকিয়ে চিকন ছড়ি করে গ্রাম্য নারীরা একধরনের মাদুর তৈরি করতো। এসব মাদুর নিজেরা বাড়িতে ব্যবহার করতেন। গরমে ঘুমাতে খুবই আরামদায়ক বলে এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। কালক্রমে পাইত্রার তৈরি মাদুরের শিল্পরূপ ঘটে। পাটিকরদের সুনিপুণ বুননে তা হয়ে ওঠে শীতলপাটি। মসৃণ আর আরামদায়ক বলেই শীতলপাটির ব্যবহার দিন দিন বাড়তে থাকে। শুরু হয় সুবিদপুরের শীতলপাটির বাণিজ্যিক উৎপাদন।
কাউখালীর শিক্ষা উদ্যোক্তা ও ইতিহাস ঐতিহ্য সংগ্রাহক মো. আব্দুল লতিফ খসরু বলেন, প্রায় দুইশত বছরের পুরানো এ শিল্প নানা সংকটে এখন কোন মতে টিকে আছে । শুরুতে এ শিল্পের সঙ্গে শতাধিক পরিবার জড়িত ছিলেন। নানা সংকটে এখন যুক্ত কেবল ২৫টি পরিবার।
পাটিগ্রামের পথ
কাউখালী উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণের সড়কে এক কিলোমিটার পথ পেরোলেই ডানে মোড় নিয়ে সুবিদপুরের রাস্তা। ওই রাস্তায় আরো দুই কিলোমিটার পথের সারি সারি বৃক্ষরাজি পেরোলেই সুবিদপুর গ্রাম। সুবিদপুর নামে মানুষ যেমন চেনেন তার চেয়ে ভাল চেনেন পাটিকর পাড়া অথবা পাটিয়াল পাড়া বলে। শীতলপাটির খ্যাতির কারনেই সুবিদপুর এখন পাটিগ্রাম।
সম্প্রতি পাটিকরপাড়া সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে নারী আর পুরুষের পাটিবুননের ব্যস্ততা। ঘরের বারান্দা আর উঠোনজুড়ে পাটির সুনিপুণ নির্মাণ চলছে বিরামহীন। নানা আকৃতি ও রঙের পাটি সূক্ষ্ম বুননে পাচ্ছে নান্দনিক শিল্পরূপ।
ষাটোর্ধ গীতা রানী পাটিকর বলেন,পাটিকররা একদম ভাল নেই । অভাব ঢুকেছে পরিবারে। আর শীতল পাটির ব্যবহারও ঠিক আগের মত নেই। সুপটু পাটিকরদের বয়স এখন বেড়ে কর্মক্ষমতাও কমে গেছে। তবুও সুবিদপুরকে এখনও মানুষ পাটিগ্রাম নামে চেনে।
পাটি বিপ্লবে নারী
সুবিদপুরের ২৫ পাটিকর পরিবারের নারীদের সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিরামহীনভাবে চলে পাটি বুননের কাজ। শীতল পাটির এ শিল্প বংশানক্রমে বেঁচে আছে শুধুই নারীর শ্রমে। কাউখালী মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা সুনন্দা সমদ্দার বলেন, সুবিদপুরের নারীদের অবিরাম শ্রমেই পাটি শিল্প এখনও কোনও মতে টিকে আছে। আর এখানে এ শিল্পের স্রষ্টাই নারী। দুইশত বছরের ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয়।
পাটি শিল্পী বিভা রানী (৩৫)বলেন,পাটি বুনতে কোমড় ধরে । হাতের চামড়া ছিঁড়ে যায়। এ কাজে ধৈর্য্য আর কষ্ট করতে হয়। না করলে পেট চলে না।
অশীতিপর বৃদ্ধা পাটিকর পুষ্প রানী বলেন, আগে আনন্দে পাটি বুনেছি। এখন বয়স বেড়ে গেছে। পাটির ব্যবহার কমেছে তাই উৎপাদনও কম। তবে শখের বশে কেউ কেউ অর্ডার দিয়ে পাটি বুনিয়ে নেয়। তাছাড়া হিন্দু পরিবারের বিয়েতে বর-কনেকে শীতলপাটি উপহার দেওয়ার রীতি এখনও চালু আছে।
পাটিকরের ক্ষরণ
উঠানজুড়ে পাটি বুননে ব্যস্ত নারীর ছবি তুলতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হল। কিছুতেই তারা ছবি তুলতে দিবেন না। সত্তোরোর্ধ বয়সী রানী বালা পাটিকর খেঁকিয়ে ওঠেন, স্বাধীনতার পর থেকে ম্যালা মাইনষে ছবি তুইলা নিছে। ছবি তুইলা কোন লাভ হয় নাই । আমরা যেমন ছিলাম তেমনই আছি। পাটির দিন এখন নাই, ছবি তুইলা কি হবে?
পাটিকর নিবাস চন্দ্র (৪৫) জানান, সুবিদপুরের মাটি এখন লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে পাটির কাঁচামাল পাইত্রা উদ্ভিদ আগের মত জন্মে না। ঝালকাঠির রাজাপুর এলাকার আইলাকাঠি গ্রামে পাইত্রা উদ্ভিদের কিছু চাষ হয়। সুবিদপুরের পাটিকরদের সেখান হতে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হয়।
স্থানীয়রা জানালেন, সুবিদপুরে পাটিকরদের এখনও যারা এ কাজে জড়িত আছেন, তাঁদের নিজস্ব জমি নেই। ফলে তাদের পক্ষে পাইত্রার আবাদ সম্ভব না। একসময় সুবিদপুরে প্রায় ৩০০ একর জমিতে মসৃন পাইত্রার জলজ উদ্ভিদ বাগান ছিল। পরিকল্পিতভাবেই এর আবাদ করতেন সুবিদপুরের মানুষ। কালক্রমে পাইত্রার বাগান ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে সুবিদপুরে বর্তমানে ২০/২৫ একর জমিতে কিছু পাইত্রা উদ্ভিদ জন্মে।
সুববিদপুরের পাটিকরদের পূনর্বাসনের লক্ষে সরকারী -বেসকারী পর্যায়ে কার্যকর কোন উদ্যোগ এ যাবৎ নেওয়া হয়নি। গত ঘূর্ণিঝড় সিডরে পাটিকর পাড়া লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এসময় ব্যাপক ক্ষতির সম্মূখিন হন পাটিকররা। ওই সময় সেনাবাহিনী পরিচালিত আশার আলো পূনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ২০টি পাটিকর পরিবারকে স্থানীয় সমবায় অধিদপ্তরের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা পূনর্বাসন সহায়তা দেওয়া হয়।
সুবিদপুর পাটি শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবীন চন্দ্র পাটিকর অভিযোগ করেন, ওই পূনর্বসনের টাকা পেতে তাঁরা নানা ভোগান্তির স্বীকার হন। তিনি বলেন,পাটি শিল্প সমিতি কার্যকর ভাবে চালু ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া এ শিল্প বাঁচানো সম্ভব হবে না।
কিছুটা অন্তর্মূখী ও পুরোটাই ভূমিহীন শীতলপাটির উদ্যোক্তা পাটিকর গোত্র। মুক্তিযুদ্ধে বিপন্নতার পর পাটি শিল্পকে বাঁচানোর স্বপ্ন দ্যাখেন পাটিকররা। গড়ে তুলেছিলেন সুবিদপুর পাটি শিল্প সমবায় সমিতি লিমিটেড। সমিতির বয়স ৩৫ বছর গড়িয়েছে। উন্নয়ন হয়নি কোন। সমিতি ঘরে জমি নিয়ে মামলা আর আত্মকলহে এক সময়ের সংগঠিত মানুষগুলো আর যেন ঘুরে দাঁড়াতেই পারছে না। সরকারি-বেসরকারি সহায়তা ছাড়া সমিতি টিকে আছে কেবল নামে। তাই একদা সংগঠিত পাটিকরদের শিল্প বাঁচানোর দায় আর স্বপ্ন যেন মরে যাচ্ছে।
ছবি : লেখক
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৬ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৫