ঢাকা: ‘নাচ ময়ূরী নাচ রে, ঝুম ঝুমা ঝুম নাচ রে, ওই এলো আকাশ ছেয়ে ওই বর্ষারানী সাজ রে...’- বর্ষার আগমনী বার্তার অসাধারণ এ গানটি সুধীন দাশ গুপ্ত লিখে গেলেও ময়ূরী কিন্তু নাচে না, নাচে ময়ূর। আকাশজুড়ে মেঘে ময়ূর নাচে পেখম মেলে, আকর্ষণ করে সঙ্গীকে।
গুমরে থাকা মেঘমেদূর বিরহী প্রকৃতি, হালকা শীতল হাওয়া, মাঝে মধ্যে ঝিরি ঝিরি বারিধারা বলে দেয় এসেছে বর্ষাঋতু। মাসজুড়ে তাপদাহের পর শেষ জ্যৈষ্ঠে শুরু হওয়া বৃষ্টি আগাম বার্তা দিয়ে এবার ধরায় এনেছে আষাঢ়।
বর্ষা এলেই সবুজে সবুজ বেড়ে প্রকৃতি হয় মোহময়। সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দেয় কেশরী কদমফুল। গ্রামবাংলায় ধরা দেয় নতুন রূপ। কৃষক মাঠে ছোটে আউশ ধানের কচি কিশলয়ে চোখ রেখে। বাড়ে নদীর প্রবাহমানতা। দুকূল ছাপিয়ে উর্বর করে শুষ্ক মাটি। বাড়ির নববধূটি উঠান, খেত ভরায় লাউ, কুমড়া, ঢেঁড়শসহ সবুজ সবজিতে। হয়তো তখন কোনো রসিক বাড়ির বধূটিকে দেখে জসীম উদ্দীনের মতো বলবে ‘কচি লাউয়ের ডগার মতো সোহাগে সে হচ্ছে ক্ষত’।
পুকুরজলে নতুন করে জেগে ওঠে মাছও। অনেকেই ঘাটে বসে পড়েন ছিপ নিয়ে। পুকুরজুড়ে মাছেদের আনন্দ সমাবেশও চোখ এড়ায় না এসময়। আর বর্ষার শুরুতে উজশী কৈ, মাগুর, টাকি, শোল মাছ ধরার মজা কেবল গ্রাম-বাংলার মানুষই জানেন। ছিপ নিয়ে ধানখেতে ছুটে চলাও নৈমিত্তিক দৃশ্য।
ঘরের জানালা দিয়ে পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা গোনা আর টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ উপভোগ করার মতো কবিমনের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। মাঠ-ঘাট-রাস্তায় উদোম শরীরে শিশুর উন্মাদনা আনে ভিন্ন মাত্রা।
পাহাড়ে এসময় সারাদিন খেলা করে রোদ-মেঘ-বৃষ্টি। লালমাটির পাহাড় ছেয়ে যায় গাঢ় সবুজে। মেঘ ঘুমায় তার কোলে। কখনো-সখনো সবুজ গ্রাস করে সাদা-কালো মেঘমালা।
বর্ষার ফুল, ফল-ফলাদিও মেলে ধরে নতুন ডালি। করমচা, জামরুল, আমড়া, পেয়ারার পাশাপাশি বাড়ির শোভা বাড়ায় মোচেন্ডা, রঙ্গন, রজনীগন্ধা, চেরি, ফ্রুস, বাগানবিলাস, দোপাটি, চামেলি প্রভৃতি ফুল। বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা ফুলগুলোকে করে তোলে আরও মোহময়।
বর্ষার প্রভাব মানবমনেও কম নয়। বর্ষাবিরহ প্রাচীন-মধ্যযুগের কাব্যের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিলো। আধুনিককালে এসেও কবিরা কম যাননি। পছন্দের মানুষকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে দূরপথে হাঁটা কিংবা দুজনে কাছাকাছি থেকে মনের কথা বলার রোম্যান্টিক একটি আবহাওয়া তৈরি করে দেয় বর্ষা।
যুগলরা এসময় এক অন্যকে উদ্দেশ্য করে বলতেই পারেন, ‘পাগলা হাওয়া বাদল দিনে, পাগল আমার মন জেগে ওঠে...’ অথবা ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়-/এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে/তপনহীন ঘন তমসায়/সে কথা শুনিবে না কেহ আর/নিভৃত নির্জন চারিধার.....আকাশে জল ঝরে অনিবার/জগতে কেহ যেন নাহি আর...’
বর্ষা যেন সত্যি প্রাণের প্রতীক। শুধু গ্রাম নয়, অস্তিত্ব সংকটে টিকে থাকা গুটিকয় গাছ-পালাকেও করে তোলে যৌবনবতী। একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে চারদেয়ালে আটকে থাকা মানুষগুলো। যদিও জলাবদ্ধতার ভোগান্তি অনেকটা কেড়ে নেয় সে শান্তির নিশ্বাস।
কবি কালিদাস মেঘদূত কাব্যে মেঘকে দূত করে পাঠিয়েছিলেন যক্ষপ্রিয়ার কাছে। যক্ষের মনের খবর পাহাড়, পর্বত, নদী-নালা পেরিয়ে মেঘ পৌঁছে দিয়েছিলো তার প্রিয়ার কাছে। মেঘ-বর্ষার সে রোম্যান্টিক ভাবনা তাই আজকের নয়, সেই আদিকাল থেকেই।
বর্ষায় জলাবদ্ধতা, বন্যার শঙ্কা সাময়িক। সারা বছর কৃষকের মুখে হাসি রাখার অবদান দীর্ঘ। সবকিছু ছাপিয়ে বর্ষা বয়ে আনুক মঙ্গলবারতা।
রবীন্দ্রনাথের মতো আমরাও বলতে চাই-
‘ওগো, কাহারে আজ জানাই আমি
কী আছে ভাষা—
আকাশপানে চেয়ে আমার
মিটেছে আশা।
হৃদয় আমার গেছে ভেসে
চাই - নে - কিছু' র স্বর্গ - শেষে,
ঘুচে গেছে এক নিমেষে
সকল পিপাসা। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৯ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৫
এএ