শ্রীমঙ্গল থেকে: বাগানের সব সেকশনে প্রতিদিন চা তোলা হয় না। বিশালায়তনের সব বাগান কাজের সুবিধার্থে বেশ কয়েকটি সেকশনে ভাগ করা থাকে।
ভাড়াউড়া চা শ্রমিক বসতি ছেড়ে এবারের গন্তব্য জাগছড়া চা বাগান। শ্রীমঙ্গলে মোট চা বাগান রয়েছে ৩৮টি। এর মধ্যে ১২টি ফিনলে কোম্পানির। ভাড়াউড়া-জাগছড়া এর মধ্যে অন্যতম।
উঁচু-নিচু সর্পিল পথ, দু’ধারে সবুজের সমারোহ। এক একটি টিলা যেন কোনো ধ্যানী শিল্পীর উন্মুক্ত ক্যানভাস। পরম মমতার আঁচড়ে গাছগুলো এঁকে দিয়েছে। মাথায় মাথালি, কাঁধে ঝোলা নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শ্রমিকরা পাতা তুলছেন। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, টিলার মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল। বিলি কেটে কেটে আপন মনে উকুন বাছছেন অসংখ্য মা।
এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য ফ্রেমবন্দি করতে গেলে ছুটে এলেন সর্দার নৃপেণ কালিন্দী (২৮)।
দুই সন্তানের বাবা নৃপেণ জানালেন, এখানে নারী শ্রমিকরা আপন মনে কাজ করেন। গরমে অনেক সময় ঊর্ধাংশের গামছা খুলে শুধু থামি (অনেকটা সায়া-ব্লাউজের মতো দেখতে) পরে কাজ করেন। প্রকৃতির সঙ্গে এমনভাবে মিশে যান যে, আলাদা কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। কিন্তু বাইরে থেকে কেউ ছবি তুলতে গেলে সর্দাররা আটকান। কারণ, তাদের সম্মানের কথা ভেবে আমরা কেউ চাই না যে, তারা ওইভাবে ছবিতে উঠুন। আপনারা তুলতে চাইলে আমি তাদের কাপড় ঠিক করে নিতে বলছি।
এই ফাঁকে প্রশ্নের প্রেক্ষিতে বুঝিয়ে দিলেন কাজের পদ্ধতি, এখানে এক একটি সেকশনে ৬০ থেকে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাদের দেখভাল করেন একজন করে সর্দার। শ্রমিক-সর্দার উভয়েরই দিনপ্রতি মজুরি ৬৯ টাকা। যাকে তারা বলেন ‘হাজিরা’। সর্দারের উপরে যুগালী সর্দার, তার হাজিরা ৮৪ টাকা। মান্থলি সর্দারের পদ যুগালীর চেয়ে উপরে হলেও হাজিরা একই। তবে চাকরিটা পাকা আর ভাতা মাসিক ভিত্তিতে পেয়ে থাকেন। এর উপর চা বাগানের নিজস্ব সব স্টাফ। সর্বেসর্বা একেবারে ম্যানেজার।
বেহুলা পানতাঁতী (৫০), গীতা বাউরি (৪৪) ও মিথিলা বাউরি (৩২)। যে জীবন শ্রমিকের, চা বাগানের- তার সঙ্গে হয় দেখা। দূর থেকে যখন দেখা হয়, তখন মনে হয় তারা একে অন্যের গা ঘেঁষে পাতা তুলছেন। কাছে গেলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়, তারা আসলে বেশ দূরে দূরে। সবার কাছে গিয়ে কথা বলা বেশ সময় ও কষ্টসাধ্য। ঝুম বৃষ্টির মতো কাজ চলছে। চোখের পলকে চায়ের জন্য কাঙ্ক্ষিত পাতাটি চলে যাচ্ছে ঝোলার মধ্যে। এক মুহূর্ত থামবার জো নেই। সারাদিনে কমপক্ষে তুলতে হবে ২৩ কেজি পাতা। না হলে খাওয়া বন্ধ। এর ফাঁকেই ছবি হলো, কথা হলো।
গীতা বাউরির মুখেই শোনা যাক, সকাল ৯টা থেকে সূর্যের আলো যতক্ষণ থাকে কাজ চলে। এর মধ্যে সারাদিনে তিনবার ‘ওজনে যাওয়া’। এটি হলো, পাতা তুলে ওজন করে খাতায় লিপিবদ্ধ করা কতটুকু তোলা হলো। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে একবার, এরপর দুপুরে ও তারপর একেবারে দিনের শেষে।
দুপুরের খাবার হিসেবে কখনও ভাত অথবা প্রায় দিনই চালভাজা। পাতা ২৩ কেজির বেশি হলে কেজি প্রতি তিনটাকা হারে আলাদা করে লেখা থাকে। সপ্তাহ শেষে হাজিরার সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয়। সাপ্তাহিক হাজিরার ৪১৪ টাকা আবার পুরোটা হাতে আসে না। প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য ৩০ ও শ্রমিক কল্যাণের জন্য পাঁচ টাকা কেটে নেওয়া হয়, যোগ করেন গীতা।
আর কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা? বক্তা এবার মিথিলা বাউরি, এখানে আমাদের বৃষ্টির মধ্যেও কাজ করতে হয়। সম্বল ওই মাথালিটুকুই। মাইলের পর মাইল শুধু চা বাগান। হঠাৎ জোর ঝড়-বৃষ্টি এলে দ্রুত নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার সুযোগ নেই। এখন প্রায়ই বজ্রপাতে মৃত্যুর খবর শুনি। নেই স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থাও। দিনে তিনবার একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাগানের পক্ষ থেকে পানি খাওয়ানো হয়। কিন্তু জায়গায় জায়গায় টিউবওয়েল থাকলে অনেক সুবিধা হয়।
এবার কাজ থামিয়েই বলতে থাকলেন, সারাদিন আমরা জোঁকের কামড় আর রোদ-বৃষ্টি সহ্য করে পাতা তুলি। এছাড়া স্প্রে করা কীটনাশক পেটে, হাতে-পায়ে ও পিঠে লেগে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হয়। এত অল্প হাজিরায় যেখানে ঠিকমতো খেতেই পাই না, সেখানে আবার চিকিৎসা!
বোঝা গেল, পাঁজর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা তাদের এই দীর্ঘশ্বাসই আসলে আমাদের চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া হয়ে মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়। সেটি যেন সামনা-সামনি দেখতে পেলাম। এক একজনের সীমাহীন দুরাবস্থার কথা লিখতে গেলে শব্দে কুলোবে না।
পাশেই কাজ করছেন জাগছড়া শ্রমিক বসতির পঞ্চায়েত সদস্য বেহুলা পানতাঁতী। অন্য সহকর্মীরা তাকে ডাকেন ‘মেমবারনি’ বলে।
এতসব সমস্যার প্রেক্ষিতে তার দায়িত্ব অন্যদের থেকে বেশি। জানালেনও সে কর্তব্যের কথা, আমরা প্রায়ই ম্যানেজারের কাছে যাই। তারা কখনও না বলেন না। বলেন, করে দেব। তারপর আর হয় না। এভাবেই চলছে। তারপরও আমরা লেগে রয়েছি। চা শ্রমিক ইউনিয়ন মালিকপক্ষের সঙ্গে নতুন চুক্তি করছে। সেখানে সমস্যাগুলো সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী (৫৫) জানান, শ্রমিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি থাকছে নতুন চুক্তিতে। আলাপ-আলোচনা চলছে; আশা করি, আগামী জুলাই মাসের মধ্যে একটি ফলাফল দাঁড়াবে।
ভাড়াউড়া বাগানের বর্তমান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি উজ্জ্বল হাজরাও জানালেন একই কথা, নতুন চুক্তিতে বাগানে কাজের পরিবেশ উন্নত করার বিষয়গুলো জোর দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, সব ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।
উজ্জ্বল ভাড়াউড়া বসতির পঞ্চায়েত সভাপতি হলেও, ভাড়াউড়া-জাগছড়াসহ সব বসতির কার্যক্রম একই।
বাগান সংশ্লিষ্ট ব্যস্ততার দরুন পাওয়া যায়নি জাগছড়া বাগানের ম্যানেজারকে। অগত্যা শরণাপন্ন হতে হলো ভাড়াউড়া চা বাগানের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) গোলাম মোহাম্মদ শিবলির। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মতো ফিনলের ১২টি চা বাগানের কর্মপদ্ধতিও একই।
এসব বিষয়ে জানালেন, ফিনলে দেশের প্রতিনিধিত্বশীল একটি চা কোম্পানি। শ্রমিকরাই আমাদের সব। বাকি চা বাগানগুলোর অবস্থা জানি না, কিন্তু আমরা তিনবার আলাদা লোক রেখে তাদের পানি খাওয়াই। আর আধুনিক স্যানিটেশনে শ্রমিকরাই স্বচ্ছন্দ নন। এর আগে, একটি এনজিও এ নিয়ে কাজ করেছিল। কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি।
এছাড়া অন্যান্য বিষয় নিয়েও আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে এবং সে অনুযায়ী কাজও চলছে বলে জানান তিনি।
পরবর্তী পর্বে থাকছে চা বাগানে নারীর কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন
বাংলাদেশ সময়: ১২১২ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৫
এসএস/জেডএম
** আমর ঘরপু দেখবা, আমর ব্যাডা-ভাতার নাই