ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

চাকা শিল্প বা দুই শিল্পীর গল্প

শরীফ খিয়াম আহমেদ ঈয়ন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১০ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৫
চাকা শিল্প বা দুই শিল্পীর গল্প

ঢাকা: চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকাটি শত শত বছর ধরে চাকা শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ বলে দাবি করেন স্থানীয়রা।

‘কাঠমিস্ত্রি আর চাকাশিল্পী এক নয়।

কাঠের কাজ জানলেই চাকা বানানো যায় না’- কাজ করতে করতেই বলছিলেন আবুল কাশেম। তার এ বক্তব্যে জড়িয়ে আছে শিল্পের গৌরব। যদিও তিনি জানেন, সেই দিন আর বেশি দূরে না, যে দিন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গরু-মহিষের গাড়ি শুধু জাদুঘরেই দেখা যাবে।

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবে সুপ্রাচীন এসব দেশি বাহন। তাই, তিনিও বলেন, আর কিছু দিন পর হারিয়ে যাবেন চাকার কারিগররাও।

কাশেমের নয় সন্তানের মধ্যে চারজন ছেলে। তাদের কেউই চাকাশিল্পী হতে চায়নি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, হয়ত বেশি খাটুনিতে কম পয়সা দেখে ওরা এ কাজ করতে চায় না।

জানা গেছে, তার ছেলেরা রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন।

এদিকে, আবুল হোসেনেরও চার ছেলে। তারাও কেউ চাকা শিল্পের প্রতি আগ্রহী নন। একজন অবশ্য বাবার সঙ্গে থেকে কাজ শিখেছিলেন। সে আবার বিদেশে চলে গেছে।

হোসেনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, একটি চাকা বানাতে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ দিন সময় লাগে। এর আগে বাবলা গাছের কাঠ চেরাই করে এক মাস রোদে শুকিয়ে কাজের উপযোগী করতে হয়। আর একটি চাকা তৈরিতে বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী এক হাজার ছয়শ টাকার বাবলা কাঠ লাগে। প্রতিটি চাকা বিক্রি হয় দুই হাজার আটশ থেকে তিন হাজার টাকায়। এক একটি চাকা প্রায় ১০ বছর গাড়িতে চলার জন্য উপযুক্ত থাকে।

আবুল কাশেম, আবুল হোসেনসহ দু’জনের গ্রামের আরো একাধিক চাকা শিল্পী জানান, তাদের এলাকায় এখনো কমপক্ষে দেড়শ চাকাশিল্পী আছেন। ১২ মাস ধরেই চাকা তৈরির কাজ চলে। তবে এই শিল্পীদের সবারই বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। অতএব আগামী ৫০ বছর পর সম্ভবত এদের একজনও আর বেঁচে থাকবেন না। বিলুপ্ত হবে ওই এলাকার চাকা শিল্পও।

দেশের অন্যান্য এলাকার চিত্রও বোধকরি খুব বেশি আলাদা হবে না। কারণ, চাকাশিল্পীদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কাঠের চাকার উপযোগিতা কমে যাওয়ার বিষয়টি অনেক আগেই পরিস্কার হয়ে গেছে।

ফিরে দেখা
মানবসভ্যতার ইতিহাসে চাকার আবিষ্কারকে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে ধরা হয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতে চাকা আবিষ্কৃত হয়। শুরুতে কুমারদের কাজে এটির ব্যবহার ছিল।

ককেশাসের উত্তর দিকে বেশ কিছু কবর পাওয়া গেছে, যাতে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছে। ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা একটি মাটির পাত্র দক্ষিণ পোল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যাতে চার চাকার একটি গাড়ির ছবি আছে। এটিই এ পর্যন্ত প্রাপ্ত চাকাযুক্ত গাড়ির ছবির সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন।

খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দ নাগাদ চাকার ব্যবহার ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় চাকার ব্যবহার শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের দিকে।

চীনে চাকার ব্যবহার দেখা যায় ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, যখন চাকাযুক্ত গাড়ির প্রচলন হয়। তবে বারবিয়েরি-লো’র (২০০০) মতে, আরো আগে খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের দিকে চীনে চাকার প্রচলন ছিল। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন সভ্যতায় চাকার ব্যবহার দেখা যায় না। তবে অলমেক ও অন্যান্য কিছু আমেরিকার সভ্যতার নিদর্শনের মধ্যে শিশুদের খেলনা হিসেবে চাকাযুক্ত গাড়ি পাওয়া গেছে।

প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এসব খেলনাতে চাকার ব্যবহার থাকলেও আমেরিকার সভ্যতাগুলোতে যানবাহনের যন্ত্রাংশ হিসেবে চাকার প্রচলন ছিল না। প্রাচীন নুবিয়াতে চাকা ব্যবহার করা হতো মাটির হাড়ি ও পাত্র তৈরিতে এবং পানি উত্তোলনে। নুবিয়ার পানি উত্তোলনে ব্যবহৃত চাকাগুলো ঘোরানো হতো গবাদিপশু দিয়ে। নুবিয়ার অধিবাসীরা মিশর থেকে আনা অশ্বচালিত রথ ব্যবহার করতেন।



চাকা ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত সমতল বা মসৃণ রাস্তা না থাকায় চাকার প্রচলন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। যেসব এলাকায় রাস্তা ছিল না এবং অসমতল ভূমির ওপর দিয়ে চলতে হয়েছে, সেসব এলাকায় চাকাযুক্ত যানবাহনের বদলে মানুষের কিংবা পশুর পিঠে করে মাল বহন করা হতো। এমনকি বিংশ শতকের আগ পর্যন্ত বিশ্বের অনুন্নত এলাকাগুলোতে ভালো রাস্তাঘাটের অভাবে চাকাযুক্ত যানবাহনের ব্যবহার ছিল কম।

শুরুতে চাকা নির্মাণ করা হতো কাঠের চাকতি দিয়ে, যার কেন্দ্রে অক্ষদণ্ডের জন্য একটি গর্ত করা হতো। স্পোকযুক্ত চাকা অনেক পরে উদ্ভাবিত হয়। এই রকমের চাকার ব্যবহার গাড়ির ওজন কমিয়ে আনে; যার ফলে দ্রুতগতির বাহন তৈরি করা সম্ভব হয়।

প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সমকালীন আন্দ্রোনভ সংস্কৃতিতে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার পাওয়া যায়। এর অল্প পড়েই ককসশাস এলাকার অধিবাসীরা অশ্বচালিত বাহনে স্পোকযুক্ত চাকা ব্যবহার করেন। মূলত যুদ্ধে ব্যবহৃত রথে এ ধরনের চাকা তারা ব্যবহার করতেন। এখান থেকে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার গ্রিক উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে। চাকাযুক্ত বাহনের ব্যবহার গ্রিক সভ্যতার বিকাশে সহায়তা করে।

খ্রিস্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দ নাগাদ কেল্টিকদের রথগুলোতে এমন চাকা ব্যবহার করা হতো, যার পরিধি বরাবর লোহার বেষ্টনী দেওয়া থাকতো। ফলে, এ ধরনের চাকাগুলো অনেক মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হতো। স্পোকযুক্ত চাকা এভাবেই প্রায় অপরিবপর্তিত অবস্থাতে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চাকায় নিউম্যাটিক টায়ার ব্যবহার শুরু হয়।

সামগ্রিকভাবে চাকার আবিষ্কার কেবল পরিবহন ব্যবস্থাই নয়, বরং প্রযুক্তির নানা দিকে নতুন নতুন যন্ত্র উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। চাকা ব্যবহার করে জলচক্র (পানি তোলার এবং পানি থেকে শক্তি আহরণের চাকা), গিয়ার চাকা, চরকা, ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

সাম্প্রতিক কালের প্রপেলার, জেট ইঞ্জিন, জাইরোস্কোপ এবং টারবাইন এর সবই চাকারই পরিবর্তিত রূপ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১১ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৫
এবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।