বগুড়া: তালা-চাবির বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। তবে ব্যবহারে সর্তক না হলে কখনও কখনও চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
অনেকেই যেমন সবকিছু লক করে মনের ভুলে গাড়ির ভেতরেই চাবি ফেলে বেরিয়ে পড়েন। পরে অফিসের কাজ বা কেনাকাটা শেষে গাড়িতে উঠতে গিয়ে বিষয়টি ধরা পড়ে। তখন যেন সবকিছু এলোমেলো লাগে। প্যান্ট-শার্টের এ পকেট ও পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেই চাবি তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
কেউ মোটরসাইকেলের তালা লক করে চাবি হারিয়ে ফেলেন। অনেকে আবার বাসাবাড়ি তালা মেরে বিভিন্ন কাজে বেরিয়ে পড়েন। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে দেখেন, সবই রয়েছে কিন্তু চাবি নেই। তখন শুরু হয় চেঁচামেচি।
বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ চাবি হারিয়ে গেলে নানা কাণ্ড করে থাকেন। কিন্তু যত কাণ্ডই ঘটান, সংশ্লিষ্ট চাবি ছাড়া তো আর তাৎক্ষণিক তালা খোলা সম্ভব নয়। হয় তালা ভাঙা, নয়তো চাবির কারিগর ডাকতে হবে। তবে সবসময় তালা ভাঙাও যায় না। সেক্ষত্রে চাবির তৈরির কারিগর ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না।
সেই কারিগরদের একজন মো. শফিকুল শেখ। বগুড়া শহরের নারুলী গ্রামে তার বসবাস। তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে রকমারি চাবি তৈরি ও তালা মেরামতের কাজ করে আসছেন। শহরের সাতমাথায় ছাউনির নিচে ‘ফয়সাল চাবি ঘর’ নামে একটি দোকান দিয়ে কাজ করেন তিনি।
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, একটি টেবিল, কয়েকটি টুল আর তিন যুগের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা। টেবিলের উপর সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা রয়েছে নানা ব্র্যান্ডের রকমারি সব তালা ও চাবির গোছা।
কেবল পেটের দায়ে তিনি আজ এ পেশায়। কখনও তালা-চাবি বানানোর কারখানার স্বপ্ন দেখেন না।
তার ভাষ্য, গরিবের স্বপ্ন দেখতে মানা। শুধু বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু হলেই যথেষ্ট।
ছাউনির নিচে বসেন আরও অন্তত ১৮ জনের মতো কারিগর। প্রত্যেকেই শফিকুলের মতো তালা-চাবি তৈরি ও মেরামতের কাজ করে থাকেন। যে কারণে পৌরসভার দেওয়া এ ছাউনিটি ‘তালা-চাবি তৈরি ও মেরামত মার্কেট’ নামে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। বলা যায়, তালা-চাবিতেই চলে তাদের সংসার।
শুক্রবার (১৯জুন) তালা-চাবি তৈরি ও মেরামতের কাজে নিয়োজিত কারিগরদের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।
নিজের সার্বিক অবস্থা নিয়ে শফিকুল জানান, প্রচণ্ড অভাবের সংসার তার। সংসারে পাঁচজন ছেলে সন্তান রয়েছে। এর মধ্যে বড় ছেলে হৃদয় শেখ দশম শ্রেণী, ফয়সাল শেখ সপ্তম শ্রেণী, মিজান শেখ চতুর্থ শ্রেণী, আলিফ শেখ প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। আর সবার ছোট আসিফ শেখের এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। বাপ-দাদার হাত ধরেই তার এ পেশায় আসা। তারাই ছিলেন তার ওস্তাদ।
শফিকুল বলেন, এই পেশা থেকে মাসে সব খরচ বাদে বড়জোর ১০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। এ সামান্য আয় দিয়েই সংসারের যাবতীয় ব্যয় বহন করতে হয়। পাশাপাশি ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ তো রয়েছেই। বুঝতেই পারছেন, কেমন রয়েছি!
তাদের মতোই একজন রাইছ উদ্দিন। বাড়ি বগুড়া শহরের সাবগ্রাম এলাকায়। তিনি কাঁচামালের ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে ওস্তাদ সাইফুল ইসলাম ও শফিকুল ইসলামের ঘরে বসতেন।
পরে তাদের কাছ থেকে কাজ শিখে ২০০০ সাল থেকে নিজেকে এ পেশায় জড়িয়ে ফেলেন। এক ছেলে, তিন মেয়ে, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে তার সংসার।
তিনি জানান, অভাবের সংসারে তো আর বসে থাকলে চলবে না, কাজ করে খেতে হবে! তাই শেখা বিদ্যা নিয়ে এ কাজে নেমেছেন। এ থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে কোনোরকম দিন চলে যাচ্ছে।
জাহাঙ্গীর আলম, শাহিনসহ একাধিক তালা-চাবি তৈরি ও মেরামতের কারিগর বাংলানিউজকে জানান, এই মার্কেটে গাড়ির লক, গ্লাস মেশিন, গাড়ির তালা, ডোর লক, ট্রাই সাইকেল লক, মোটরসাইকেল লক, ইয়াং লক, হ্যান্ডেল লক, ক্যাশবাক্সের তালাসহ বিভিন্ন ধরনের তালা মেরামত ও নতুন চাবি তৈরি করা হয়।
তারা আরও জানান, তাদের স্থায়ীভাবে বসার কোনো জায়গা নেই। পৌরসভার দেওয়া জায়গায় বসে গত তিন বছর ধরে এ কাজ করছেন। শুরুতে তারা একটানা প্রায় ৩০ বছর শহরের থানা রোডে বসে কাজ করেছেন। এরপর তাদের সেখান থেকে উঠিয়ে পোস্ট অফিসের পাশে বসতে দেওয়া হয়। সেখানে তারা প্রায় ছয় বছর ছিলেন।
এছাড়া পুঁজির চরম সঙ্কটে কোনোরকম বেঁচে থাকার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তারা।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৩ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৫
এমবিএইচ/এসএস