রেমা-কালেঙ্গা থেকে ফিরে: এখানে সূর্য ডুবলে এক অদ্ভুত মায়াময় ভুবনের দেখা মেলে। মাথার উপর তারা, একটু পরপর উঁচু-নিচু টিলা, বালিয়াড়ী অন্ধকার।
গিয়েই যে নৈসর্গিক আঁধারের দেখা মিলেছে ব্যাপারটা এমন নয়। কালেঙ্গায় পা দিতেই ঝুম বৃষ্টি। খানিক বাদে বর্ষণ ধুয়ে-মুছে একাকার, লতা-পাতার ফাঁক গলে মিঠে রোদ তারপর আবার বৃষ্টি।
প্রথমে রেমা-কালেঙ্গা লিখে এরপর শুধু ‘কালেঙ্গা’ লেখার কারণ রয়েছে। ভৌগলিক অবস্থানে রেমা-কালেঙ্গা হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায়। ত্রিপুরা সীমান্ত সংলগ্ন ১৪২৮১ একর পাহাড়ি অঞ্চল বন বিভাগের সংরক্ষিত এলাকা। ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠা করে পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এটি আরও সম্প্রসারণ করা হয়। গোটা অঞ্চল রেমা, কালেঙ্গা, ছনবাড়ি ও রশিদপুর- এ চারটি বিটে ভাগ করা। বিস্তীর্ণ এ অঞ্চলটি যেহেতু প্রাকৃতিক বনাঞ্চল, এজন্য বনের দেখভালের জন্য রয়েছে ১১টি ইউনিট ও ৭টি ক্যাম্প।
১৪২৮১ একরের মধ্যে প্রায় ৪৪৩৭ একর এলাকা গড়ে উঠেছে জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য হিসেবে। এর সিংহভাগ কালেঙ্গা ও অল্প কিছু অংশ পড়েছে রেমা বিটে। এজন্য নাম রেমা-কালেঙ্গা কিন্তু মূল বিট আসলে কালেঙ্গা। সুন্দরবনের পরে সবদিক দিয়ে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমি। এছাড়া শুকনো ও চিরহরিৎ এ বন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল।
ঢাকা থেকে রেমা-কালেঙ্গা দুইভাবে যাওয়া যায়। এক, সরাসরি শায়েস্তাগঞ্জ গিয়ে সেখান থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা চেপে। দুই, শ্রীমঙ্গল গিয়ে সেখান থেকে সরাসরি জিপগাড়ি চেপে পাহাড়ি চড়াই-উতরাই পেরিয়ে রেমা-কালেঙ্গার গেট। কিন্তু বর্ষাকালে কাদা জমে চলার অবস্থায় থাকে না বলে পথটি বন্ধ থাকে।
মন অবশ্য পাহাড়ি আঁকাবাকা পথে পড়ে থাকলেও, বাধ্য হয়ে রেমা-কালেঙ্গা অভিযানে আমরা ধরেছিলাম শায়েস্তাগঞ্জের পথ। যদিও সেটিকে আর পথ না বলাই ভালো! চামনবাড়ির একটু আগ দিয়ে শেষ হয়েছে পাকা রাস্তা। এরপর বাকি চার-পাঁচ কিমি. রাস্তা মাটির। এমনিতে বর্ষাকাল, রাস্তায় জল-কাদা জমে রাস্তা আর রাস্তা নেই। খানিক বাদে আবিষ্কার করলাম, আমাদের অটোরিকশা সিন্দাবাদের জাহাজ বনে গেছে, মাঝসমুদ্রের এই ঝড়-ঝাপটা সামলে কবে-কখন যে কালেঙ্গা উপকূলে পৌঁছাবো, তা অনিশ্চিত!
যাইহোক, কীভাবে পৌঁছালাম সে অন্য গল্পে বলা যাবে। আপাতত পৌঁছানো গেছে এই শান্তি! এখানকার টিলাগুলোর গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২১০ থেকে ২২০ ফুট। পাহাড়ি অঞ্চলের ভৌগলিক বৈশিষ্ঠ হলো, দ্রুত সূর্য ডোবে ও বৃষ্টি নামে। আর রয়েছি বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল শ্রীমঙ্গলের একদম গা ঘেঁসে। বাকিটা আর না বললেও চলবে।
একটু স্থির হয়ে বসতেই দেখি, সূর্য মধ্যগগনে। সময় আর বৃষ্টির সমীকরণ মিলিয়ে বুঝলাম, দিনের অরণ্য বেশিক্ষণ কপালে জুটবে না, কাজেই বেরিয়ে পড়তে হবে এখনই।
কী বুঝে কে জানে, হঠাৎ করেই মুখ কালো করে ফেললো অরণ্য। একটু পরই শোঁ শোঁ শব্দ। একপাল ডাকাত বুঝি বনের ভেতর থেকে হা রে রে করে লাঠি-সোটা নিয়ে তেড়ে আসছে। এরপর পৌনে একঘণ্টা চললো অদৃশ্য বোয়িং থেকে বৃষ্টিবর্ষণ। তাতে নগরের ইট-পাথরের জেলখানা থেকে আনা চারকোনা মন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন রূপ পেল। শুরু হলো অরণ্যের দিনরাত্রি যাপন।
বৃষ্টির জল এঁকে-বেঁকে কোথায় গেছে সেই সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম পিছন পিছন। কখনও উঁচু কখনও নিচু কাদামাটির মায়াবী পথ। দু’ধারে চাপালিশ, সেগুন, কড়ই, বহেড়া, ডুমুর আর চেনা-অচেনা লতার ঝোপ। আকাশ ফকফকা, কোথাও বৃষ্টির ছিটেফোটা নেই। কিন্তু বনের ভেতরে অচমকা বৃষ্টি! পরে জানা গেল, গাছের আড়মোড়া। বৃষ্টির সময় গাছের পাতা, ডাল ও কুঁড়ির ফাঁকে জল জমে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ বাতাসে নড়ে উঠলে ঝমঝম বৃষ্টি বলে ভ্রম হয়।
ব্যাপারটি বুঝিয়ে বললেন যাত্রাসঙ্গী ইকো গাইড তাজুল ইসলাম স্বপন। ঢাকা গাইড অ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রশিক্ষিত এ গাইড বন বিভাগের সঙ্গে কাজ করেন। বনে নানা জীব-জন্তুর ভিড়। নির্ভয়ে চলাফেরা করে বলেই এটি অভয়ারণ্য। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য গাইড ছাড়া বনে ঢোকা বারণ। নিরাপত্তা ছাড়াও সুবিশাল এ বনে একা ঘুরতে বেরোলে হারানোর সম্ভাবনা শতভাগ।
বন বিভাগের তথ্য অনুয়ায়ী, এ অভয়ারণ্যে রয়েছে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি। এছাড়া ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম রয়েছে।
পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালির মধ্যে বিরল প্রজাতির মালায়ন বড় কাঠবিড়ালির একমাত্র বসবাস এ বনেই। দেখা মেলে তিন প্রজাতির বানর কুলু, রেসাস আর লজ্জাবতীর। এছাড়াও রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, বন্যশুকর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু ইত্যাদি। বনের ১৮ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াস, লাউডগা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ভীমরাজ, টিয়া, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবৌরি, শকুন, মথুরা, বনমোরগ, পেঁচা, মাছরাঙ্গা, ঈগল, চিল ইত্যাদি।
বৃষ্টি হলে গাছেরা হয়ে ওঠে আরও সবুজ, কিন্তু পশুপাখি একদম বেরোয় না। বহুদূরে ভীত হরিণের উঁকি নেই, গাছে ঝুলে ঝুলে বানর-হনুমানের ভেংচি নেই। ওদের বন অথচ ওদের সঙ্গে দেখা না হওয়ার আক্ষেপ নিয়ে ঘুরতে হলো বন। তবে রোদ-বৃষ্টি যাইহোক, রক্তচোষা জোঁকেদের প্রতিদিন ঈদ। তার ওপর এমন অফসিজনে গোটা কয়েক মানুষ পেলে তো কথাই নেই!
বিজিবি ক্যাম্প ফেলে কিছুদূর সামনে এগুলেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নায়েক আব্দুল মান্নান বীর উত্তমের সমাধি। এরপর ওয়াচ টাওয়ার, আঁকা-বাঁকা বেশ কয়েকটি লেক আর সুউচ্চ গাছ পেরিয়ে আমরা তখন বনের একদম গহীনে। আবারও বৃষ্টিবর্ষণ। এবার আর থামাথামি নেই, গাছের তলা দিয়ে গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে এগিয়ে চলা। আবহসঙ্গীতে রিমঝিম বৃষ্টির নূপূরধ্বনি, বৃষ্টি থামলে পাখির কলতান। উড়ে উড়ে এ গাছ থেকে ওগাছ। কোনো কোনো গাছ দূর থেকে দেখে মনে হয় বনে এখন শীতকাল। গাছভর্তি শুকনো পাতা, ঝরিয়ে নবপল্লবিত বসন্তের অপেক্ষায়। গাইড জানালেন, আসলে গাছভর্তি শালিকের দল। শুকনো পাতার মতো লেপ্টে রয়েছে।
যেতে যেতে হঠাৎ ধুপধাপ শব্দ। দূর থেকে কারা যেন অনবরত ঢিল ছুড়ছে। আমরা যারপরনাই অবাক! এই বৃষ্টিবিধৌত বনে কার এমন ক্ষতি করলাম আমরা যে, ইট-পাটকেল ছুড়ে স্বাগত জানাতে হবে! কাছে যেতেই বোঝা গেল, ইট-পাটকেল নয়, টুপটাপ পড়ছে আধা খাওয়া পাকা আম। ভালো আমও রয়েছে। গাছের গোড়ার চারপাশে গোল হয়ে শুধু আমের ছড়াছড়ি। উপরে তাকালে সবুজের ভিড়ে কেবল লাল ঠোঁট আর আমের হলদে শরীর চোখে পড়ে। লাল ঠোঁটগুলো টিয়াপাখির। আমের মৌসুমে যেন গাছ ইজারা নিয়েছে টিয়ার দল।
পরে রেঞ্জ অফিসার জানিয়েছিলেন, এগুলো উড়ি আম। গভীর বনের দিকে এ প্রজাতির আমই বেশি। ছোট ছোট দু’ইঞ্চি সাইজের আমগুলো মজার হলেও আঁটি বড়। আঁটি আর খোসা বাদ দিলে শাঁস খুবই সামান্য। তারপরও মন্দ নয়। কিছু নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করতেই গাইড বললেন, বনের আম বনে খেতেই ভালো!
এভাবে মাইলের পর মাইল আম-কাঁঠালের গাছ। পশুপাখি ছাড়া কেউ দয়া করে পেড়ে না নিয়ে গেলে মৃত্তিকালিঙ্গনই এসবের অন্তিম নিয়তি।
বনের একেবারে শেষ দিকটা, যেখানে ত্রিপুরা সীমান্ত মিশেছে সেখানে বেশকয়েকটি আদিবাসী গোষ্ঠীর বাস। এর মধ্যে উড়ং, সাঁওতাল, কর্মকার, খাড়িয়া উল্লেখযোগ্য। কৃষিকাজই তাদের প্রধান পেশা। তাদের গল্প হবে অন্য প্রতিবেদনে।
হাঁটতে হাঁটতে বেলা শেষের দিকে, শেষ পায়ের ক্ষমতাও। এদিকে, বৃষ্টিরও জিরেন নেই বরং বাড়ছে। অগত্যা বাড়ির পথ ধরাই ঠিক মনে হলো সবার। বাড়ি বলতে বনবিভাগের বাংলো। রাতে বনের রূপ দেখতেই এ ব্যবস্থা।
শুরুতে যেমন বলছিলাম, রাত্রি নামতেই বদলে গেল দৃশ্যপট। দিনে যে বৃষ্টি হয়েছে তা বোঝার উপায় নেই। আকাশে রীতিমতো ঝকমকে তারা।
রাত ১০টা নাগাদ শালবন দিয়ে শুরু হলো নবপর্বের যাত্রা। বৃষ্টি নেই কিন্তু পথ সেই আগের মতো জল-কাদায় মোড়া। বনের আঁধার অনেকটা গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকে। সারাক্ষণ মনে হবে, ঝপ করে এই বুঝি জড়িয়ে ধরলো!
কোথায় পা পড়ছে এতসব ভাবার অবকাশ নেই। গাইডের সতর্ক নির্দেশ, দ্রুত পা চালালে জোঁক কম লাগে। দিনে যেখানে দু’তিনঘণ্টা পর পর জামা-কাপড় চেক করা হয়েছিল, রাতে সেখানে আধঘণ্টা পরপর। তাও কী রক্ষা হয়!
বনের রাত হলো বিরামহীন ঝিঁঝিঁময়। অন্য পশুপাখিরা চুপটি করে ঘরে বসে থাকলেও, মেছোবাঘ আর অজগর ঠিকই বেরোয়। যদিও ঝোপঝাড় আগের চেয়ে পাতলা হয়ে যাওয়ায় মোছোবাঘেরা রেমার গভীর বনের দিকে চলে গেছে বলে স্থানীয়দের মত। তবে অজগর বাবাজির চরে বেড়ানো থামেনি এখনও। যদিও ভয় পাবো বলে অজগর নেই বলে সাহস দিলেন গাইড।
তবে একটি কথা ঠিক, অরণ্যের এ অপার নৈসর্গ উপভোগ করতে একা বেরোলেই যত বিপদ। গাইড নিয়ে বেরোলে ভয় একেবারে নেই বললেই চলে। কারণ, বনের নিরাপদ রাস্তাগুলো তাদের নখদর্পণে।
রাতের গল্প আরও হবে। আঁধার ঘাড়ে করে রাত্রিকালীন অভিযান শেষ হলো মধ্যরাতে। নীড়ে ফিরে কেবলই মনে হতে লাগলো, কোথায় যেন মায়া রহিয়া গেছে!
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৮ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৫
এসএস