রেমা-কালেঙ্গা থেকে ফিরে: তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। ট্রেকিং করে করে কখন যে আমরা ঘনবনে ঢুকে গেছি বুঝতে পারিনি।
রেমা-কালেঙ্গা আসার পথে রাস্তার ব্যাপক দুরবস্থা অনেকটাই ক্লান্ত করে তুলেছিল আমাদের। তবু দেহ-মনকে চাঙ্গা করে রেখেছিল এ অভয়ারণ্য। পৌঁছানো মাত্রই উড়ে গেল সব ক্লান্তি! বনের অকৃত্রিম সবুজে নাগরিক কায়ক্লেশ রূপ নিল পরম প্রশান্তিতে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের পরে সবদিক দিয়ে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমি। এছাড়া শুকনো ও চিরহরিৎ এ বন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল।
বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য বলে কথা, নিরাপত্তার স্বার্থে ইকো গাইড ছাড়া বনে ঢোকা নিষেধ। তাই বনপর্বে আমাদের যাত্রাসঙ্গী ঢাকা গাইড অ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাজুল ইসলাম স্বপন। তিনি একই সঙ্গে ইকো গাইড, পাশাপাশি সংরক্ষিত এ বনাঞ্চলের একজন স্থানীয় বাসিন্দাও বটে। রেমা-কালেঙ্গা বন তিনি হাতের তালুর মতোই চেনেন।
জানালেন, বাংলাদেশে যে কয়েকটি প্রাকৃতিক বনভূমি এখনও ভালো অবস্থায় টিকে রয়েছে, রেমা-কালেঙ্গা তার মধ্যে অন্যতম।
এখানে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা-লতাগুল্ম রয়েছে।
পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালির মধ্যে বিরল প্রজাতির মালায়ন বড় কাঠবিড়ালির একমাত্র বসবাস এ বনেই। দেখা মেলে তিন প্রজাতির বানর কুলু, রেসাস আর লজ্জাবতীর। এছাড়াও রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, বন্যশুকর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু ইত্যাদি। বনের ১৮ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে অজগর, কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াস, লাউডগা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ভীমরাজ, টিয়া, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবৌরি, শকুন, মথুরা, বনমোরগ, পেঁচা, মাছরাঙ্গা, ঈগল, চিল ইত্যাদি।
প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়ায় বন্যপ্রাণীর দেখা মেলেনি একেবারে। তবু দু-তিন প্রজাতির পাখি ও প্রাণী বৃষ্টির মধ্যেও স্বাগত জানিয়েছে আমাদের। সান্ত্বনা ওইটুকুই।
ওয়াচ টাওয়ার ওঠার সময় শামুকখোল (এশিয়ান ওপেনবিল) পাখিকে বিশাল ডানা মেলে উড়ে যেতে দেখলাম। এরা বক জাতীয় পাখি। মুহূর্তেই আনন্দের মাত্রা অন্য রূপ নিল। ফেরার পথে কয়েকবার শ্যামা ঘুঘুকে (এমার্ল্ড ডাভ) এ গাছ থেকে ও গাছ করতে দেখা গেল। বনের নির্জনতায় জোট বেঁধে খাবারের সন্ধানে ব্যস্ত ওরা।
তবে এখানে আসার সার্থকতা খুঁজে পেলাম বড় কাঠবিড়ালিকে (ব্ল্যাক জায়ান্ট স্কুইরেল) এক পলক দেখে। কালো-সাদা রঙ মেশানো লম্বা লেজটি শেষ বিকেলে অপরূপ সৌন্দর্য ছড়ালো। আমাদের দেশে যত প্রজাতির কাঠবিড়ালি দেখা যায়, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বড়। এদের মাথা থেকে শরীরের দৈর্ঘ্য ৪২ সেমি. ও লেজের দৈর্ঘ্য ৬০ সেমি।
ডাকবাংলোতে মাঝে মাঝেই এসে ঢু মেরে যায় কুলু বানর (নর্দান পিগ-টেইলড ম্যাকাক)। সাধারণ বানরের চেয়ে এরা একটু বড় আকৃতির। এদের মাথা থেকে শরীরের দৈর্ঘ্য ৫৫ সেমি. ও লেজের দৈর্ঘ্য ২০ সেমি.।
রেমা-কালেঙ্গা বন ঘুরে এলাম আর একটি বিশেষ প্রাণীর কথা হবে না তা কি হয়! মশাইয়ের নাম জোঁক। কেঁচোর মতো লম্বা রক্তচোষা এ প্রাণী পঁচা লতা-পাতা থেকে জন্ম নেয়। তবে আশার কথা হলো, যে এলাকায় জোকের উপদ্রব বেশি, সে এলাকার জীববৈচিত্র্য (বায়োডায়ভারসিটি) তত ভালো। রেমা-কালেঙ্গায় সাধারণত তিন প্রজাতির জোঁক দেখা যায়। এদের আঞ্চলিক নাম হলো- চিনা জোঁক, পাইনা জোঁক ও মহিষা জোঁক। যত সতর্কই আপনি হোন না কেন, এদের রক্তক্ষয়ী সাক্ষাৎ আপনাকে পেতেই হবে!
বন ঘুরে এসে নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় বিট অফিসার মাহবুব হোসেনের সঙ্গে।
বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা নিয়ে জানালেন, শুকনো মৌসুমে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল এ দুই মাস বনে আগুন লাগার সম্ভাবনা বেশি থাকে। হঠাৎ করে আগুন ধরে বনের ছোট ও মাঝারি আকারের গাছগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হয়। অনেক কীটপতঙ্গ ও পাখিদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে।
আগুন কীভাবে লাগে জিজ্ঞেস করতে মাহবুব বলেন, অসচেতন কোনো ব্যক্তি যদি জ্বলন্ত সিগারেটের গোড়া মাটিতে ফেলে দেন, তাহলে এ থেকে আগুন লেগে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩১ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৫
বিবি/এসএস/
** পাহাড়ের ভাঁজে অরণ্যের দিনরাত্রি