ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

কখনও বলেছি, ভালোবাসি বাবা!

মিছিল খন্দকার, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০১ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৫
কখনও বলেছি, ভালোবাসি বাবা!

ঢাকা: মাস ছয়েক আগের কথা। একদিন দুপুরবেলা কারওয়ান বাজারের একটা রেস্টুরেন্টে বসে ভাত খাচ্ছিলাম।

আমার টেবিলের সামনের সিটে এক মধ্য বয়সী ভদ্রলোক ফোনে কথা বলছিলেন আর সিঙাড়া খাচ্ছিলেন।

তার কথায় বোঝা যাচ্ছিল, ফোনের ওই প্রান্তে তার স্ত্রী। তিনি তাকে বলছিলেন, অফিসে খুব কাজের চাপ যাচ্ছে। তার মধ্যে আবার ছাঁটাই হচ্ছে। এ নিয়ে তিনি তার স্ত্রীকে অবশ্য চিন্তা করতে বারণ করলেন। কিন্তু ভদ্রলোকটির মুখে স্পষ্ট উদ্বেগের ছাপ।

স্ত্রীকে বলছিলেন, বাসাটা পাল্টে একটা ছোটো বাসা নিলে হয় না? ছেলে-মেয়ের স্কুল-কোচিং, টিচারের বেতন আর সংসার খরচ চালানোর পর বাসা ভাড়াটা অনেক চাপ হয়ে যাচ্ছে। এর ফাঁকে তিনি সিঙাড়া খাওয়া শেষে দুই গ্লাস পানি পান করলেন। কপালের ঘাম মুছলেন।

তখন বোধহয় ও প্রান্ত থেকে তার স্ত্রী বলছিলেন, তাহলে ওদের বাসার শিক্ষককে না করে দিই? তিনি প্রতিবাদের সুরে বলছিলেন, না না। ওদের পড়াশুনার ক্ষতি হবে এতে। পড়াশুনার ক্ষেত্রে ওদের কোনো প্রয়োজন যেন অপূর্ণ না থাকে।  

সন্তানের প্রতি তীব্র আবেগ আর ভালোবাসা মিশ্রিত কণ্ঠে তিনি তার স্ত্রীকে বলছিলেন, ওরা যেন কখনও বুঝতে না পারে, ওদের পড়াশুনার খরচ চালাতে বাবার বেশ কষ্ট হচ্ছে। ওদের এসব কখনও বুঝতে দেবে না। তাহলে দুশ্চিন্তায় পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটবে।

তার স্ত্রী হয়ত ওপাশ থেকে বলছিলেন, তাহলে আমি একটা চাকরি-বাকরি নেওয়ার চেষ্টা করি? তিনি তার উত্তরে বলছিলেন, ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে তোমাকে স্কুলের চাকরিটা ছাড়তে হলো। এখন ওদের পড়াশুনার খোঁজখবর তুমিই নিচ্ছো। আমিতো আর একদম সময় দিতে পারি না ওদের। না না, তোমার কোনো কাজের দরকার নেই।  

মোবাইলে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। তার বয়স আমার বাবার বয়সের কাছাকাছি। নিম্নমধ্যবিত্ত শুকনা মুখ। হয়তো সকালে দু’টো রুটি আর সবজি খেয়ে বেরিয়েছেন। সংসার খরচ চালাতে টানাটানি। এভাবে প্রতিদিনই হয়ত টাকা বাঁচাতে শুকনো মুখে দু’টো সিঙাড়া খেয়েই দুপুরটা পার করে দেন।

হয়ত অফিসের এতো চাপ, ছাঁটাইয়ের উদ্বেগ, সংসারের টানাটানি মনের মধ্যে গোপন করে সন্তানের সব চাওয়া যে করেই হোক পূরণ করেন। তাদের বুঝতেও দেন, এ শহরে জীবন সংগ্রামে তাকে কতোটা নাকাল হতে হয় পদে পদে! এ শুধু একজন বাবার গল্প। তবে একই সঙ্গে এটি নিম্নমধ্যবিত্ত সব বাবার গল্প।

আমার বাবার একটা ঘটনা মনে পড়লে নিজের অজান্তেই চোখ চিকচিক করে। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। বাবার বদলির কারণে দাদা-দাদী, ফুপু-চাচার যৌথ পরিবারে ছেড়ে থানা শহরে একটা ভাড়া বাসায় উঠেছি। টিনশেড বাসা। প্রচণ্ড গরম। আমাদের বাসায় একটা ফ্যান, সেটা বাবা-মার ঘরে।

নতুন বাসায় ওঠার পর প্রথম দিন দুপুরে একটু ঘুমিয়েছি। ঘুম ভাঙলে দেখি, বাবার হাত আমার চিবুকে।
তিনি গামছা দিয়ে আমার ঘাম মুছে দিচ্ছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায়ই তিনি সিলিঙ ফ্যান কিনে আনলেন। কিন্তু সেদিন জানতে পারিনি যে, বাবা তার উপহার পাওয়া স্বর্ণের চেইনটা বিক্রি করে ওই সিলিং ফ্যানটা কিনেছিলেন।

এই হলো বাবা। যার কাছে হাজারো আবদার করি। তিনি শত কষ্ট আর অভাবের মধ্যেও সেসব পূরণের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আমাদের কোনো কষ্ট বুঝতে দেন না। সাধ্যে না কুলালে তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। হয়ত প্রতিদিন অফিস টাইমে দুপুরে না খেয়ে টাকা বাঁচিয়েই সন্তানের আবদার রাখেন।

আমাদের সবার বাবার মুখে এমন হাজারো গল্প লুকানো থাকে। আমরা কি কখনও পড়ে দেখেছি? বাবাকে জড়িয়ে ধরে কি কখনও বলেছি, বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসি! দূরে গেলে কি বলেছি, খুব মিস করছি বাবা!

বাংলাদেশ সময়: ১০০২ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৫
আরএম

** বাবার জন্য ভালোবাসা
** বাবা দিবস যেভাবে এলো

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।